খাবারের খোঁজে চট্টগ্রামের পথে পথে গরিবের ঢল

রোহিঙ্গাদের দুদর্শাই যেন ফিরে এল বাংলাদেশের বুকে

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। অঘোষিতভাবে দেশে চলছে ‘লকডাউন’ পরিস্থিতি। চারদিকে বন্ধ। কর্মহীন হয়ে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষদের বড় একটি অংশ। ‘দিনে আনি দিনে খাই’— এমন পরিবারগুলোর অবস্থা শোচনীয়।

সংবাদকর্মী হিসেবে আমার ঘরে থাকার সুযোগ নেই। গত ১ এপ্রিল বুধবারও নিত্যদিনের মতো সংবাদ সংগ্রহে বের হই। সড়কে দেখি অনেক নারী-পুরুষের পথচলা। দেখেই বোঝা যায় অভাবী মানুষের দল। অতীতে বাংলাদেশে অনেক হরতাল-অবরোধ দেখেছি। তখনও শ্রমজীবী মানুষেরা সাময়িক সময়ের জন্য শ্রমবিক্রির সুযোগ হারিয়েছিলেন। কিন্তু এখনকার মতো ‘পথে নামতে’ হয়নি। কিন্তু করোনাভাইরাস এখন বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের বড় একটি অংশকে রীতিমতো ‘পথে নামিয়েছে।’

আগের দিন সোমবার শ্রমজীবী ও দরিদ্র নারীদের ছবি তুলে আলাদা নিউজ করেছিলাম। তাই বুধবারও তাঁদের পথচলার দৃশ্যে ‘নতুনত্ব’ নেই ভেবে আপন গতিতে চলি।

দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের সামনে ওয়াসামুখী পথে দেখি, নগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের সামনে গেটে অনেক মানুষের ভিড়। দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। এখানেও ‘নতুন’ কিছু পেলাম না যেন। কারণ, ‘নিউজ করেছি’ ভাবনা।

ওয়াসা মোড় হয়ে এমএ আজিজ স্টেডিয়াম ধরে পৌঁছি কোতোয়ালী থানা মোড়ে। দেখি অনেকগুলো মানুষ থানার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। দেখেই বুঝে নিই, ত্রাণের আশায় জড়ো হয়েছেন।

থানায় প্রবেশ করতে গিয়েও সামাজিক দূরত্বের কথা বিবেচনা করে প্রবেশ করলাম না। বাইরে দুজন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তাঁরা লোকমুখে শুনেছেন পুলিশ ত্রাণ দিচ্ছে। এই কারণেই অপেক্ষা করছেন।

কথা শেষে কিছুটা দূরে গিয়ে ফোন করি ট্রাফিক উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার মো. শহীদুল্লাহকে। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ট্রাফিক বিভাগের একটি তথ্য জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘অফিসে আসুন, আমি অফিসেই আছি।’ শুনে কিছুটা ভালো লাগলো। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার এই সময়ে অন্তত এই কর্তা অফিসে ডাকলেন। বললাম, ‘আসা কি ঠিক হবে?’ বললেন, ‘আরে চলে আসুন।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছলাম ট্রাফিক উত্তর বিভাগের সদরঘাটস্থ কার্যালয়ে। ও মা, গেটে দেখি দরিদ্র মানুষের ভিড়!

নগর পুলিশের তিনটি কার্যালয় যথাক্রমে নগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয়, কোতোয়ালী থানা এবং ট্রাফিক বিভাগের সামনে অভিন্ন চিত্র দেখে বিস্মিত হলাম। ভাবলাম, সত্যিই মানুষ বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছে। না হলে ‘থানার সামনে কানাও যায় না’— এই প্রবাদবাক্য মিথ্যে প্রমাণ করে দরিদ্র মানুষগুলো কেন খাবারের আশায় থানার গেটে যাবে?

তিনটি পুলিশ কার্যালয়ের সামনে দরিদ্র মানুষের এমন চিত্র দেখে মনে পড়ল ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের কথা। ওই সময় পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার সরকার বলপূর্বক বাস্তুুচ্যুত করেছিল কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় আট লাখ মানুষ অনুপ্রবেশ করেছিল বাংলাদেশে।

কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক হিসেবে দুই বছরে দুই দফা কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফে গিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরির প্রয়োজনে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেখানেই দেখেছিলাম, খাবারের জন্য অভুক্ত রোহিঙ্গাদের নিদারুণ হাহাকার। রোহিঙ্গা বলে, নিপীড়িত বলে, বাস্তুচ্যুত বলে-ওদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ মানুষের মানবিক সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল।

২০১৭ সালে লাখো বাঙালি খাবার, বস্ত্র কিংবা টাকা নিয়ে ছুটে গিয়েছিল রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করতে কক্সবাজার জেলায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা দিতে সেনাবাহিনীকেও দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার।

ওই সময় উখিয়া এবং টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘুরে ঘুরে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠাচ্ছিলাম কালের কণ্ঠে। অভুক্ত, অনাহারে থাকা, পালিয়ে বেঁচে ফেরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম তখন।

ওই সময় একবারের জন্যও ভাবিনি, আজ যে রোহিঙ্গারা খাবারের সন্ধানে ছুটছে, তাদের মতো বাংলাদেশের মানুষরাও একদিন খাবারের সন্ধানে এদিক-সেদিক ছুটবে। সরকারি কার্যালয় কিংবা বিত্তবানদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে।

ওই সময় কীভেবেছি, না ভেবেছি সেটা বড় নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, গত ৩০ মার্চ থেকে সোমবার থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত চারদিন চট্টগ্রাম নগরীর রাজপথে ঘুরে ঘুরে সেসব মানুষদের দেখছি, যারা খাবারের সন্ধানে এদিকে-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

বুধ-বৃহস্পতি দুইদিনে দুই দফা বিক্ষোভও দেখলাম। বুধবার দুপুরে নগরীর জিইসির মোড়ের বাটাগলির সামনে ত্রাণ দিচ্ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু। প্রায় এক হাজার পরিবারের জন্য সহায়তার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সেখানে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান নওফেল উপস্থিত হয়ে ত্রাণ বিতরণ করেন। কিন্তু ত্রাণ নিতে এসেছিলেন হাজারেরও বেশি মানুষ। ফলে না পাওয়া মানুষগুলো ক্ষুব্ধ হয়ে সড়কে অবস্থান নেন। পরে পুলিশকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে।

আবার, বৃহস্পতিবার বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে খোদ থানা কম্পাউন্ডে। বন্দর থানা কম্পাউন্ডে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন নগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান। তিনি ফিরে যাওয়ার পর থানা কম্পাউন্ডে প্রবেশ করেন শতাধিক মানুষ। তারা ত্রাণের দাবি জানান। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য, রাতের অন্ধকারে মানুষের বাড়ির দরজায় গিয়ে ত্রাণ দেবেন। থানা থেকে ত্রাণ বিতরণের পরিকল্পনা ছিল না। এই কারণে ত্রাণ না পেয়ে ক্ষুব্ধ লোকজন বিক্ষোভ শুরু করেন। পুলিশ তাদের বুঝিয়ে থানা কম্পাউন্ড থেকে বের করে দিতে সমর্থ হয়।

২০১৭ সালে দেখা ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের মুখগুলো মনের আয়নায় বারবার ভেসে উঠছে বাংলাদেশের এই মানুষগুলোর মুখ দেখে। রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে বাঁচতে এসেছিল। সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আসায় তাঁদের তাৎক্ষণিক খাবারের প্রয়োজন ছিল। তারা খাবারের সন্ধানে ছুটেছিল সে সময়।

কিন্তু এক অদৃশ্য করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ‘লকডাউনের’ মধ্যেই বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষরা শ্রমবিক্রি করতে না পেরে খাবারের সন্ধানে এভাবে সরকারি দপ্তরের সামনে ধরনা দেবে— এটা ভাবতেই পারি না। করোনাভাইরাসের কারণে গৃহকর্মীর কাজ হারানো রহিমার কথা মনে পড়ছে। যাঁর সঙ্গে ওয়াসা মোড়ে কথা হয়েছিল। বলেছিলেন, ‘আমি ভিক্ষুক নই, বাসায় কাজ করতাম, করুণার (করোনা) কারণে চাকরি চলে গেছে, দুধের সন্তানকে খাওয়াতে না পেরেই রাস্তায় এসেছি কিছু পাওয়ার আশায়।’

কাজীর দেউরি এলাকার টাইলস মার্কেটের সামনে কাজের আশায় বসে থাকা হাবিবের কথা মনে পড়ছে। এই হাবিব জীবনেও কারো কাছে হাত পাতেননি, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কারো কাছে কিছু চাইবেন না। তিনি কাজ চান। টাইলস শ্রমিক হাবিবদের এখন প্রধান শত্রু— করোনাভাইরাস।

মিয়ানমার সরকার বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে রোহিঙ্গাদের যে দুদর্শায় ফেলেছিল আর অদৃশ্য এক করোনাভাইরাস এখন পুরো পৃথিবীকেই ঝুঁকিতে ফেলেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষদেরও। যারা প্রকৃতপক্ষে ভিক্ষুক নন— শ্রমজীবী। এই শ্রমজীবীরাই আজ রোহিঙ্গাদের মতোই এই দরজা থেকে ওই দরজায় পা ফেলছে একটু সহায়তার আশায়।

এসএম রানা : প্রতিবেদক, কালের কণ্ঠ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!