ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে !

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ! 1ইমরান হোসাইন, পেকুয়া : অবৈধভাবে চিংড়িঘের ও লবণের মাঠ তৈরি করার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায় ২০০একর প্যারাবনের হাজার হাজার গাছ নিধন করায় পেকুয়া উপজেলার উপকূলীয় ইউনিয়ন মগনামা, উজানটিয়া, করিয়ারদিয়া দ্বীপসহ চকরিয়া উপজেলার রামপুর, বদরখালী, বহলতলী, চরণদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ, লেইমশাখালী, ধুরং, মহেশখালী উপজেলার ধলঘাট, মাতারবাড়ী, শাপলাপুরের প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষতির হুমকির মুখে রয়েছে।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছিল কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা। ২৫বছরেও সেই ক্ষতি এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি ভুক্তভোগীরা। সৃজিত হয়নি প্যারাবন। যা আছে তারও দৈন্যদশা চলছে এখন। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূল রক্ষায় ১৯৯১সালের পরে কক্সবাজারের মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া ও কুতুবদিয়ার সমুদ্র উপকূলের বেড়িবাঁধ ও চরভাটা এলাকায় ব্যাপকভাবে প্যারাবন সৃজনের কথা থাকলেও তা এত বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। এই ২৫বছরের মধ্যে যেসব এলাকায় প্যারাবন সৃজন হয়েছে তার বেশির ভাগই আবার উজাড় হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত প্যারাবন নিধন চলছেই। বনবিভাগ প্যারাবন সৃজনের নামে উক্ত সময়ের মধ্যে কোটি টাকা লোপাট করছে বলে পরিবেশবাদীদের অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্যারাবন নিধন করে চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ ও শুঁটকিমহাল তৈরি করছেন। গত ২৫বছরে চকরিয়ার রামপুর, বদরখালী, বহলতলী, চরণদ্বীপ, পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া, করিয়ারদিয়া, মগনামা এবং কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ, লেইমশাখালী, ধুরংসহ উপকূলীয় এলাকায় অন্তত পাঁচ হাজার একর প্যারাবন অবৈধ দখলে চলে গেছে।

জানা গেছে, ১৯৯১সালের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী চকরিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়া উপকূলীয় বেড়িবাঁধ রক্ষায় ব্যাপকভাবে প্যারাবন সৃজন করে জাপানের পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়েস্কা ইন্টারন্যাশনাল। সংগঠনটি নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে উপকূল রক্ষায় প্রায় এক হাজার একর এলাকায় প্যারাবন সৃজন করলেও প্যারাবন রক্ষায় দৃশ্যত কোন পদক্ষেপ নেয়নি বনবিভাগ। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান উবিনীগও মহেশখালীর শাপলাপুরে ও চকরিয়ার বদরখালীতে কিছু প্যারাবন সৃজন করেছে। ২০০২ সালে বদরখালী কৃষি সমবায় ও উপনিবেশ সমিতি প্যারাবন নিধন করে প্রায় ২০০একর চিংড়িঘের তৈরি করে। প্রভাবশালী নেতাদের চাপের মুখে মামলাও নেয়নি থানা পুলিশ।

বদরখালী এলাকার বাসিন্দারা জানান, ১৯৯১সালে যেখানে প্যারাবন ছিল। সেখানে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে যে প্যারাবনগুলো ধ্বংস হয়েছিল তাও সৃজন করা হয়নি।

উজানটিয়ার করিয়ারদিয়া দ্বীপের দক্ষিন পশ্চিম পাশে নির্মাণাধীন সেতুর মাতারবাড়ী অংশের উত্তর পূর্বপাশে প্যারাবন উজাড় করে অবৈধভাবে চিংড়িঘের ও লবন মাঠ তৈরি করছে প্রভাবশালীরা। এতে উপকূলের নিরাপত্তার ছায়া হিসাবে খ্যাত প্যারাবন নিধনে দ্বীপ রক্ষাকারী বেড়িবাঁধের প্রায় ৪ কিলোমিটার হুমকির মুখে পড়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় প্যারাবন বলতে আছে শুধু গাছের গোড়ালি, নেই কোনো গাছ। স্থানীয় লোকজন গাছের গোড়া গুলোও তুলে নিচ্ছে।

এলাকাবাসীদের অভিযোগ, স্থানীয় কয়েকটি প্রভাবশালী চক্রের সাথে মগনামা এবং উজানটিয়ার ও করিয়ারদিয়ার প্রভাবশালীরা মিলে মহেশখালী উপজেলার উপকূলীয় দ্বীপ ইউনিয়ন মাতারবাড়ীসহ পেকুয়া উপকূলীয় অঞ্চলের প্যারাবন নিধনের উৎসবে মেতেছে।

পেকুুয়া উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ করিদিয়াসহ, উজানটিয়া, মগনামা, রাজাখালীর প্রায় ১৪০একর সৃজিত প্যারাবনের বাইন, গোলপাতা, কেরবা, নুনিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ নিধন চলছে। ১৯৭৭-৮৬সালে ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ির উত্তর-পূর্ব টেকের ঘোনা, পশ্চিমের ঝাঁউবন, ইদ্রিসের ঘোনা, পেকুয়া উপকূলীয় অঞ্চলসহ উজানটিয়া প্যারাবনের হাজার হাজার একর আয়তন বেষ্টিত সবুজ শ্যামল গাছ প্রভাবশালী চক্র কেটে সাবাড়ে ব্যস্ত, যার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে উপকূলের প্রাায় তিন লক্ষাধিক জনগণ ও তাদের সম্পদ।

এলাকাবাসী জানায়, উপকূলীয় এসব প্যারাবন ১৯৯১ ও ১৯৯৭সালের ঘূর্ণিঝড় এবং সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রোয়ানোসহ বিভিন্ন সময়ে জলোচ্ছ্বাস থেকে এলাকার লোকজনকে রক্ষা করলেও এখন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করার জন্য এ এলাকায় পর্যাপ্ত প্যারাবন নেই।

মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, প্যারাবনের গাছ নিধন করার কারণে উপকূলীয় ইউনিয়ন মগনামার মানুষ এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। প্যারাবনের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে যাঁরা চিংড়িঘেরের মালিক, তাঁরাই চিংড়িঘের তৈরি করার জন্য নির্বিচারে গাছ নিধন করেছেন।

এব্যাপারে উপকূলীয় বনবিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. হুমাইয়ুন কবির বলেন, প্যারাবন তো ২০০৬সালের দিকেই উজাড় হয়ে গেছে। তৎকালীন সময়ে আমরা জড়িতদের বিরুদ্ধে ১০-১২টি পৃথক মামলা দায়ের করেছি। যা এখন মহামান্য হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বিগত বছর তিনেকের মধ্যে আমরা সংশ্লিষ্ট এলাকায় ৪০হেক্টর প্যারাবন, ১৫হেক্টর এলাকায় ম্যানগ্রোভ বন সৃজন করেছি। কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল এলাকায় ১০হেক্টর এলাকায় গোলপাতা গাছ সৃজন করেছি। এছাড়া আমারা বেশ কয়েকটি প্রকল্প মন্ত্রানালয়ে সাবমিট করে রেখেছি। যা খুব শীঘ্রই বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করছি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!