ক্রিকেটের জন্মস্থানে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ের উত্তেজনা

ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট লড়াই আজ

ক্রিকেট নিছকই একটি খেলা। খেলাধুলায় উত্তেজনা-উম্মাদনা প্রতিযোগিতাকে আরও সৌন্দর্য করে তুলে। কিন্তু সেটি যখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্য হয়ে থাকে তখন সেটি আর নিছকই খেলা থাকে না, হয়ে উঠে যুদ্ধ। ভারত-পাকিস্তানের মতো চাইলে তো প্রতিটি দ্বৈরথের ওপরই রোমাঞ্চের চাঁদতিলক বসানো যায়। কিন্তু ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তানের মতো আগ্রহ-উত্তেজনা-উন্মাদনার সৌন্দর্য ছড়ায় আর কোন লড়াই? এটি যে শুধু ব্যাট-বলের টক্করে সীমিত থাকে না, ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বহু দূর। দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক যুদ্ধের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে ২২ গজ।
ক্রিকেটের জন্মস্থানে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ের উত্তেজনা 1
আবারও লড়াইয়ে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। মহা অনিশ্চয়তার মোড়কে ঢাকা স্নায়ুচাপের অগ্নিপরীক্ষার ম্যাচের ঘটনাস্থল এবার ক্রিকেটেরই জন্মভূমি বা তীর্থভূমি ইংল্যান্ডের শহর ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড। টি-টুয়েন্টি বিশ্ব আসরের প্রথম সংস্করণের মহানাটকীয় এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির গত আসরের ফাইনালের দুই প্রতিপক্ষ আবার সামনাসামনি। যে লড়াইকে ক্রিকেটের তীর্থভূমিতে, ক্রিকেটের ‘মহাযুদ্ধ’ বললেও হয়তো ভুল হবে না।

ভারত-পাকিস্তান যখনই ক্রিকেট মাঠে পরস্পরের বিরুদ্ধে নামে, তখনই উত্তেজক কিছু ঘটে। এবারও তেমন কিছুর আশায় রয়েছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। উত্তেজনার পারদ যখন বাড়ছে, তখন এই ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনায় আছেন দুই দেশের সাবেকরাও। তাই ম্যাচটি দেখতে আগেই ইংল্যান্ডে পা রেখেছেন ভারত-পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী দলের অনেক সদস্য।

ভারত-পাকিস্তান লড়াই মানেই অন্যরকম আবহ। ক্রিকেটের মাঝেও যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। এই একটি লড়াইয়ের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকেন ক্রিকেট সমর্থকরা। আগে তো হরহামেশাই দেখা যেত। দুই দেশের রাজনৈতিক বৈরিতায় বহুল প্রতীক্ষিত সেই লড়াইটি এখন দেখা যায় কালেভদ্রে, শুধু আইসিসির ইভেন্টগুলোতে।

এই আইসিসির ইভেন্টের বদৌলতেই আজ (রোববার) আরও একবার ভারত-পাকিস্তান মহারণ দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। যে ম্যাচ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ সবার। কে জিতবে এবারের লড়াই?
ক্রিকেটের জন্মস্থানে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ের উত্তেজনা 2
পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বকাপ বলেই এই লড়াইয়ে ফেবারিট থাকবে ভারত। কেননা এখন পর্যন্ত এই টুর্নামেন্টে ছয়বারের দেখায় প্রতিবারই পাকিস্তানকে হারিয়েছে দলটি। আজ জিততে হলে সেই ইতিহাস বদলাতে হবে সরফরাজ আহমেদদের।

যদিও অন্য একটি পরিসংখ্যান আশার আলো দেখাতে পারে পাকিস্তানি ক্রিকেট সমর্থকদের। বিশ্বকাপে ব্যর্থ হলেও ভারতের চেয়ে কিন্তু সব মিলিয়ে এগিয়েই রয়েছে পাকিস্তান।

এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ১৩১ বার। এর মধ্যে ৭৩টি ম্যাচে জয় পেয়েছে পাকিস্তান। ভারত জিতেছে ৫৪টি। ৪টি ম্যাচের কোনো ফল হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে, ওয়ানডে পরিসংখ্যানে ভারতের চেয়ে পাকিস্তান বেশ বড় ব্যবধানেই এগিয়ে। ১৯টি ম্যাচ বেশি জিতেছে তারা। শুধু এই পরিসংখ্যান নয়, মুখোমুখি সর্বশেষ দেখায়ও ভারতকে নাকাল করেছে পাকিস্তান।

ইংল্যান্ডে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে সর্বশেষ মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। সে ম্যাচে ভারতকে ১৮০ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা জেতে পাকিস্তান। এবার বিশ্বকাপও হচ্ছে সেই ইংল্যান্ডে। ইতিহাস কি বদলাতে পারবে সরফরাজের দল?

আজ ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে সে লড়াইটি নিঃসন্দেহে বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সূচি। রাজনৈতিক কারণে ক্রিকেট মাঠে দুই দলের দেখা কম হয় বলে আকর্ষণ বেড়েছে আরো। অথচ কী আশ্চর্য, এটিকে আর দশটি ম্যাচের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলির!

ক্রিকেটের জন্মস্থানে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ের উত্তেজনা 3
কোহলি-আমিরের লড়াইয়ে যে জিতবে তার দল এগিয়ে যাবে অনেকখানি।

কাল ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে আসেন তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের সিংহভাগই পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আলাদা গুরুত্ব নিয়ে। শুরুতেই কোহলি যখন এর সঙ্গে একমত হন না, তখন ধেয়ে আসে প্রশ্নের ঝাঁক। কিন্তু অনড় ভারত অধিনায়ককে নাড়ানো যায় না, ‘প্রতিপক্ষ নিয়ে ততটা ভাবছি না। সে কারণে পাকিস্তানের কেউ আমাদের জন্য হুমকি না। কোনো এক ক্রিকেটারকে বাকি ১০ জনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না। আমরা ভারতীয় ক্রিকেট দল হিসেবে মাঠে নামি এবং সামনে যে প্রতিপক্ষই আসুক, তাদের হারানোর চেষ্টা করি। যদি ভালো খেলি, তাহলে জিতব। খারাপ খেললে অন্যরা আমাদের হারিয়ে দিতে পারে। প্রতিপক্ষ দল কিংবা তাদের নির্দিষ্ট কোনো ক্রিকেটার নিয়ে আমরা কখনোই আলাদা করে কিছু ভাবি না।’ প্রতিপক্ষ পাকিস্তান হওয়ার পরও সেটি কি সম্ভব? একগুঁয়ের মতো বলে যান কোহলি, ‘পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বলে ভিন্ন কোনো আলোচনা আক্ষরিক অর্থেই করিনি আমরা। ড্রেসিংরুমের আবহ এতটুকু পাল্টায়নি। দেশের হয়ে খেলা প্রতিটি ম্যাচের সঙ্গেই আবেগ জড়িয়ে থাকে। কোনো ম্যাচকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা বেশি স্পেশাল বলে আমাদের কাছে মনে হয় না। জাতীয় দলের হয়ে খেলার দায়িত্বটাই এই যে, প্রতিটি ম্যাচই সমান গুরুত্ব দিয়ে খেলা।’

কিছুক্ষণ পর সংবাদ সম্মেলনে আসা পাকিস্তান কোচ মিকি আর্থারের কাছে প্রথম প্রশ্নটিই ছিল এ প্রসঙ্গে। এতবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও যে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ে আলাদা গুরুত্বারোপ করেননি কোহলি, তা নিয়ে। জবাবে পাকিস্তান কোচের মুখ থেকেও ভিন্ন কিছু বেরোয় না, ‘অন্য ম্যাচ জিতলে যত পয়েন্ট পাব—এ ম্যাচ জিতলেও সেই ২ পয়েন্টই পাব। অবশ্যই এ ম্যাচ ঘিরে উন্মাদনা রয়েছে; অনেক সময় ধরেই গণমাধ্যম তা তৈরি করেছে। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা বরং এ ম্যাচ খেলার জন্য প্রস্তুত রয়েছি পুরোপুরি।’

ক্রিকেটের জন্মস্থানে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ের উত্তেজনা 4
বৃষ্টির কারণে অনেকগুলো ম্যাচ এরই মধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। চোখ রাঙাচ্ছে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচেও। সেটিরই কাল্পনিক ছবি নিজের টুইটারে প্রকাশ করেছেন শোয়েব আক্তার।

ইদানীং দল দুটির দেখা হয় খুব মাঝেসাঝে। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির গ্রুপ পর্বে ১২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে জেতে ভারত; ফাইনালে আবার প্রতিপক্ষকে ১৮০ রানে হারিয়ে ট্রফি জিতে নেয় পাকিস্তান। গত বছর এশিয়া কাপের দুই সাক্ষাতেই স্বচ্ছন্দ জয় ভারতের—৮ উইকেট ও ৯ উইকেটের ব্যবধানে। তাই বলে আজকের ম্যাচের আগে যে ফেভারিট তকমায় আয়েশি হয়ে আছে কোহলির দল, তা নয়। অধিনায়কের কথাতেই তা স্পষ্ট, ‘আমরা জানি যে, পাকিস্তান দলে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার আছে। আবার একই সঙ্গে এ-ও জানি, আমরা দল হিসেবে ভালো খেলতে পারলে খুবই ভালো খেলি। বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে সেটি দেখিয়েছি। নিজেদের তাই কী করা উচিত, সেদিকেই মনোযোগ দিচ্ছি। প্রতিপক্ষ নিয়ে ততটা ভাবনা নেই। আমরা বরং নিজেদের শক্তির দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, দল হিসেবে ভালো খেললে পৃথিবীর যেকোনো দলকে আমরা হারাতে পারব।’
ক্রিকেটের জন্মস্থানে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ের উত্তেজনা 5
বৃষ্টির হাত থেকে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটি বাঁচাতে আইসিসিও নতুন প্রযুক্তি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে।

এ বিশ্বকাপ বিবেচনাতেও আজকের দ্বৈরথের গুরুত্ব অনেক। প্রথম দুই ম্যাচ জিতে কিছুটা নির্ভার থাকা ভারতের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ায়। অধারাবাহিক পাকিস্তান নিজেদের ‘সুনামের ধারাবাহিকতা’ ধরে রেখে চার খেলার মধ্যে হেরেছে দুটিতে; হারিয়েছে হট ফেভারিট ইংল্যান্ডকে আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। আজকের জয় দুই দলের জন্যই তাই হতে পারে উজ্জীবনী সুধা। ২ পয়েন্টেই শুধু নয়, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারানোর আত্মবিশ্বাসের কারণেও।

কিন্তু সব আয়োজনে আক্ষরিক অর্থেই জল ঢেলে দিতে পারে বৃষ্টি। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের আকাশে যে মেঘের ছায়া! তবু আশায় আছেন সবাই। কোহলি-আর্থাররা যতই উন্মাদনা কমানোর চেষ্টা করুন না কেন, দ্বৈরথটা তো ভারত-পাকিস্তানের। সে রোমাঞ্চ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগের পূর্বশর্তে ম্যানচেস্টার আকাশের দিকেই তাই প্রথমে তাকিয়ে থাকবেন দর্শক-সমর্থকরা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!