ক্রসফায়ারে খুন স্কুলছাত্রের মায়ের মামলায় ওসি ও কাউন্সিলরসহ ১৩ জনের নাম

চট্টগ্রামে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদীনকে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে হত্যার অভিযোগে বায়েজিদ বোস্তামী থানার সাবেক ওসি আতাউর রহমানসহ সাত পুলিশ এবং চসিকের সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন নিহত ওই শিক্ষার্থীর মা।

শিক্ষার্থী জয়নালের মা জোহরা বেগম বুধবার (৭ অক্টোবর) চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মূখ্য মহানগর হাকিম মো. মহিউদ্দিন মুরাদের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন।

এর মধ্যে আদালত ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছেন। এরা হলেন এসআই গোলাম মোহাম্মদ নাছিম হোসেন, পুলিশের কথিত সোর্স ফোরকান, ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলী, তার পিএস শামসু, ইলিয়াস ও মিঠু কুমার দে।

আদালত এই ছয়জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ২৩ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনারকে (উত্তর) নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্তে বাকিদের বিষয়ে সম্পৃক্ততার তথ্য পেলে প্রতিবেদন পাওয়ার পর আদালত নির্দেশনা দেবেন বলে জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে বায়েজিদ বোস্তামি থানার সাবেক ওসি আতাউর রহমানসহ সাত পুলিশের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালত আমলে নেননি। অন্য ছয় পুলিশ সদস্য হলেন বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই নোমান, এসআই দীপঙ্কর, পুলিশ সদস্য আলাউদ্দিন, কন্সটেবল মাসুদ রানা, স্থানীয় বাসিন্দা হারুন ও লাল সুমন।

২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাতে বায়েজিদের আমিন জুট মিল এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদীন নিহত হন বলে পুলিশ দাবি করে। কিন্তু এর অল্পদিন পরেই ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে— যখন আসল আসামি জয়নাল হঠাৎ আইনজীবীর মাধ্যমে ওই মামলায় হাজিরা দেন আদালতে। প্রশ্ন ওঠে তখনই— তাহলে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেল কোন্ জয়নাল?

এরপরই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সহায়তায় আসামিরা শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদীনকে হত্যার অভিযোগে তার মা জোহরা বেগম একটি মামলা করেন।

অনুসন্ধানে নেমে দেখা যায়, আসল জয়নালের বদলে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানা পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া নিরাপরাধ জয়নাল। নামে মিল থাকলেও দুজনেরই পিতা ও ঠিকানা আলাদা। এদের একজনের সঙ্গে অন্যজনের দূরতম সম্পর্কও নেই। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত জয়নাল নোয়াখালীর মাইজদীর নুরুল ইসলামের ছেলে। অন্যদিকে মামলার আসল আসামি জয়নাল চট্টগ্রাম নগরীর রৌফাবাদ পাহাড়িকা আবাসিক এলাকার আবদুল জলিলের ছেলে।

এদিকে আবার জানা গেছে, নামের মামুলি ভুলে নয়, জেনেশুনেই ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছে দশম শ্রেণির ছাত্র জয়নালকে। এর নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে স্থানীয় এক সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতার আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। তাদের দ্বন্দ্বের বলি হয়েছে নিরীহ ছাত্রটি।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩ নভেম্বর বায়েজিদ থানার রৌফাবাদ পাহাড়িকা আবাসিক এলাকার শাহ আলম নামে এক ব্যক্তির বাসায় ঢুকে মারধর, হত্যাচেষ্টা ও চুরির ঘটনায় সাতজনের নামে মামলা হয়। এতে স্থানীয় বখাটে মো. জয়নালকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। নানা নাটকীয় ঘটনার পর চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে বিচারাধীন এই মামলার কার্যক্রম বর্তমানে রয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বায়েজিদ পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণ হারানো জয়নাল প্রকৃতপক্ষে এই মামলার আসামিই নন। বায়েজিদের ভোকেশনাল অ্যান্ড টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তিনি। ভাগ্যের পরিহাস, ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাত ১টায় নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের মাঠেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নিরীহ জয়নাল। বায়েজিদ পুলিশ তখন বরাবরের মতোই গণমাধ্যমকে বলেছিল— নিহত জয়নাল ‘বেশ কয়েকটি মামলার আসামি’ এবং ‘দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী’।

এদিকে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে মামলার প্রকৃত আসামি আসল জয়নাল আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে থাকায় পুলিশ এখন কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত নিরীহ তরুণ জয়নালকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে— এমন অভিযোগ তার পরিবারের।

জানা গেছে, নিরীহ জয়নাল নিহত হওয়ার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দীপংকর চন্দ্র রায় আসামির তালিকা থেকে আসল জয়নালের নামটি বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশিট দেন গত বছরের ১৫ অক্টোবর। সেই অভিযোগপত্রে তিনি লিখেছেন— ‘এজাহারের ২ নম্বর আসামি মো. জয়নাল, পিতা আবদুল জলিল পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তার নিহত হওয়ার সব বিষয় ও কাগজপত্র মামলার কেস ডকেটে (সিডিতে) নোট রাখি। একাধিকবার চিঠি দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসি) সংগ্রহ করেছি।’

এই চার্জশিট আদালতে দাখিল করার পর আদালত ওই মামলার দুই নম্বর আসামি ‘মৃত’ জয়নালকে অব্যাহতি দেন। কিন্তু এরপরই আদালতে হাজিরা দিতে আসেন আসল আসামি জয়নাল। এভাবে এরই মধ্যে মোট তিন দফা শুনানিতে হাজিরা দেন প্রকৃত আসামি জয়নাল। মূলত এ সময়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নামের ভুল বা অন্য কোনো বিশেষ কারণে আসল আসামির বদলে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণ হারিয়েছেন নিরাপরাধ এক জয়নাল।

আসল আসামি মো. জয়নাল জানিয়েছেন, ‘আমাকে মারতে গিয়ে হয়তো জয়নাল নামে আমিন জুট মিল এলাকার একটি ছেলেকে পুলিশ মেরে ফেলেছে। হায়াত আছে বলে এখনও বেঁচে আছি। আমি মরে গেছি ভেবে পুলিশ চার্জশিট থেকেও নাম বাদ দিয়ে দেয়। যেহেতু বেঁচে আছি, তাই পুলিশ মামলা থেকে নাম বাদ দিলেও আদালতে আসামি হিসেবে হাজিরা দিয়ে জীবনকে রক্ষা করতে চাইছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!