‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিক’ মাশরাফির রাজসিক বিদায়

বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ও সফলতম ওয়ানডে ‘অধিনায়ক মাশরাফির বিদায়’- তখন ভক্ত, সমর্থক, অনুরাগীর মন খারাপের একশটা কারণ থাকতেই পারে। এমনিতেই যেকোনো বিদায়ই বেদনার, যন্ত্রণার। ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’ মাশরাফির বিদায়ের রাগিণীটা অন্যরকম। দেশের ক্রিকেট ভক্তদের মনে বাজছিল বিদায়ের করুণ সুর। চারিদিকে রাজ্যের আফসোস, ইশ মাশরাফি আর অধিনায়ক থাকবেন না, টস করতে নামবেন না। ভাবতেও যে কষ্ট হয়!

বাংলাদেশ দলে অধিনায়ক মাশরাফি মানেই অনুপ্রেরণার প্রতীক, নির্ভীক-সাহসী এক অভিভাবক। যার শেখানো মন্ত্রে দীক্ষিত প্রতিটি ক্রিকেটার। তাই মাশরাফি মানে শুধু দল পরিচালনাকারী নন। বাড়তি উদ্যম এবং প্রাণশক্তির উৎসও বটে। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় দফায় ওয়ানডে অধিনায়কের দায়িত্ব নেয়ার পর মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছিলেন জিম্বাবুয়েকে। পাঁচ ম্যাচের সিরিজে সফরকারীদের হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। মাশরাফির অধিনায়কত্ব অধ্যায়ের শেষটাও জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করেই (৩-০) হল।

জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশের সঙ্গে সঙ্গে অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি পূর্ণ করেছেন জয়ের ফিফটি। ৮৮ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে জয় উপহার দিয়েছেন ৫০টি। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে শেষ জয়টি এসেছে বৃষ্টি আইনে ১২৩ রানে।

টানা চার সিরিজে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করল বাংলাদেশ। সবগুলোতেই নেতৃত্ব দিয়েছেন মাশরাফি। জিম্বাবুয়েকে টানা ১৭ ম্যাচ হারানোর কীর্তিও রেখে গেলেন দেশসেরা অধিনায়ক।

সন্ধ্যায় সিলেটের আকাশ কাঁদল। শুরু হল বর্ষণ। খেলার মাঝে বিরতি পড়ায় অধিনায়কের শেষটা দীর্ঘ হল। রাত বাড়ল, তবুও কিছু দর্শক মাঠে থাকলেন, মাশরাফির পাশে থাকলেন। সবার ভালোবাসার বৃষ্টিতে সিক্ত হলেন ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিক।

বিকেলে দর্শকে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় গ্যালারি। স্টেডিয়ামের বাইরে তখনও অনেক দর্শক। প্রিয় মাশরাফিকে ভালোবাসা কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছেন তারা। ক্রিকেটভক্তদের ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে গেছেন মাশরাফি। হাত নাড়িয়ে দিয়েছেন অভিবাদনের জবাব।

শেষবার টস করে মাঠ ছাড়ার সময় গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের সামনের দর্শকরা চিৎকার করছিলেন মাশরাফিকে কাছে পেয়ে। তাদের ডাকে সাড়াও দেন ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিক। রাত বাড়ে করতালি, চিৎকার তবু থামে না।

‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিক’ মাশরাফির রাজসিক বিদায় 1
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জীবনের শেষবারের মতো টস করছেন দেশের সবচেয়ে সফল ক্যাপ্টেন মাশরাফি

২০০১ সালে জাতীয় দলে জায়গা করে নেন গতির ঝড় তোলা মাশরাফী। ২০০৯-এ টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব পান তিনি। চোটে পড়ায় বেশিদিন পালন করতে পারেননি দায়িত্ব। একবছর পর ওয়ানডে দলের নেতৃত্বও পেয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র ৭ ম্যাচ পর আবার ইনজুরি। হাঁটুতে বারবার অস্ত্রোপচারের ফলে প্রিয় সংস্করণ টেস্ট খেলা থেকে বিরত থাকতে হয় তাকে।

গতি কমিয়ে বোলিংয়ে বৈচিত্র্য এনে নতুন শুরু করেন নড়াইল এক্সপ্রেস। ২০১৪ সালে ফের ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি অধিনায়ক হয়ে ফিরে আসেন। তার পেছনের সব আক্ষেপ পূর্ণতা পেতে থাকে ওয়ানডেতে একের পর এক সাফল্যে।

তার আগের সময়টায় মুশফিকুর রহিমের অধীনে হারের ভারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল দলের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের যোগ্যতা নিয়ে শুরু হয়েছিল আলোচনা-সমালোচনা। মাশরাফবর অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট পায় নতুন ভোরের সন্ধান। জয়ের বিশ্বাস দলের মধ্যে ছড়াতে থাকেন অধিনায়ক। রূপকথার মতোই বদলাতে থাকে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স।

তরুণ ও অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে দল হয়ে ওঠে শক্তিশালী। ভারত, পাকিস্তান, সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিনটি হোম সিরিজ জেতে বাংলাদেশ। মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে পুরো বিশ্বকে চমকে দেয়। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলে বাংলাদেশ।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পথ ধরেই ২০১৯ বিশ্বকাপে জাগে বড় অর্জনের সম্ভাবনা। কিন্তু স্বপ্ন হোঁচট খায় মাঝপথে। বোলিংয়ে নির্বিষ থাকেন মাশরাফি। আট ম্যাচে বাংলাদেশ জয় পায় তিনটিতে।

ওয়ানডে অবসর নিয়েও তৈরি হয়েছিল চাপ। বিসিবি সংশ্লিষ্ট অনেকেই প্রত্যাশা করছিলেন বিশ্বকাপ শেষ হতেই ক্যারিয়ারেরও শেষ বলে দিক মাশরাফি। পারফরম্যান্স, রাজনীতিতে আসা, সবকিছু নিয়েই সমালোচনা হচ্ছিল। অবশেষে অনেকটা চাপের মুখেই নেতৃত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্তটা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডের আগে নিয়ে নেন। অধিনায়কের ভূমিকায় মাশরাফিকে আর দেখা না গেলেও পারফর‌ম্যান্স ঠিক থাকলে তাকে আবারও দেখা যেতে পারে বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সিতে কলার উঁচিয়ে মাঠে নামতে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!