কোটি টাকার চাঁদার ভাগ চট্টগ্রাম মেডিকেলে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে, স্নায়ুযুদ্ধে নাছির ও নওফেল অনুসারীরা

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ও হাসপাতালে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মাঝে বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পেছনে মূলে আছে টাকার ভাগবাটোয়ারা। চমেক এলাকায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, হাসপাতালে খাবার সরবরাহে মাসোহারা আদায় নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ রয়েছে সবসময়ই— যা কোনো কোনো সময় রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে।

দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থক ছাত্রলীগের একটি পক্ষ চট্টগ্রাম মেডিকেলকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। তবে গত দেড় বছর ধরে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সমর্থক অপর গ্রুপের উত্থান হয়েছে। তারাও এখন চাঁদাবাজির জায়গাগুলোতে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চাইছে। এতেই বাধছে বিপত্তি। এর ফলে বারবার ঘটছে মারামারির ঘটনা।

চট্টগ্রাম মেডিকেলকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের বিবাদমান দুই গ্রুপই একে অপরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ দিয়ে আসছে। আবার দুই পক্ষই চাঁদাবাজির অভিযোগটি নিজেদের ঘাড়ে নিতে নারাজ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল এলাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন আদায়, ফার্মেসি, দোকান ও ভাসমান হকারদের থেকে চাঁদা আদায়ই মূলত সব হানাহানির অন্যতম কারণ।

যেখানে সরকারি মেডিকেল সীমানার অভ্যন্তরে কোনো ওষুধের দোকান থাকার নিয়ম নেই সেখানে এখন দোকান উঠেছে দুটি।
যেখানে সরকারি মেডিকেল সীমানার অভ্যন্তরে কোনো ওষুধের দোকান থাকার নিয়ম নেই সেখানে এখন দোকান উঠেছে দুটি।

একাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল এলাকার আশেপাশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বিভিন্ন প্রোগ্রামের নামে ২০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করে চমেক ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংসদ। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারি পরীক্ষার নির্ধারিত মূল্য থেকেও অতিরিক্ত কমিশন নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে।

জরুরি বিভাগের বাম পাশে আরেকটি ‘ন্যায্যমূল্যের দোকান’ দেওয়া হয়েছে। যেখানে সরকারি মেডিকেল সীমানার অভ্যন্তরে কোনো ওষুধের দোকান থাকার নিয়ম নেই সেখানে এখন দোকান উঠেছে দুটি। আর সেই দোকান দুটির মালিক একই ব্যক্তি বলে জানা গেছে। তাছাড়া দোকান দুটির মধ্যে আগেরটি চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ও বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল এবং নতুনটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে দাবি করেছেন, এরকম কোনো কিছুর সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই।

এছাড়া চমেকের আশেপাশের শতাধিক ফার্মেসি ও দোকান থেকে দৈনিক ৫০০ থেকে ১ হাজার চাঁদা আদায় করা হয়। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, খাবার সরবরাহে মাসোহারা, চাঁদাবাজির হিসাব ধরলে মাস শেষে কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যায়। এই চাঁদাবাজির টাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য চমেক ছাত্রলীগের মধ্যে বারবার সংঘর্ষ হচ্ছে— সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই এ বিষয়ে একমত।

কেবল আধিপত্যের দ্বন্দ্বে গত দেড় বছরে দুই পক্ষের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে অন্তত ১০ বার। সংঘর্ষ এড়াতে ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এরপরেও বিবাদমান দুই গ্রুপ বিভিন্ন মিছিল, সভা ও রাজনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যেই ইন্টার্ন ডাক্তারদের সংগঠন ও পাল্টা সংগঠন ঘিরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে হঠাৎ বেড়েছে উত্তাপ। সোমবার (১৫ নভেম্বর) সকালে প্রথমবারের মতো যাত্রা শুরু করে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর নওফেল অনুসারীদের সংগঠন ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ। এরপর একই দিন রাতে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উ্দ্দিনের অনুসারীদের সংগঠন ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতোদিন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন নাছিরের অনুসারীরা। এখন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের মাঝেও দুই সংগঠন হওয়ায় মেডিকেলের রাজনীতিতে স্নায়ুর লড়াই আরও বাড়বে— এমন শঙ্কা অনেকেরই।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে সর্বশেষ মারামারির ঘটনা ঘটে গত ২৯ অক্টোবর রাতে। এর পর দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে গুরুতর আহত এমবিবিএম দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আকিব মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থেকে বর্তমানে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ ঘটনার পর কলেজের শ্রেণী কার্যক্রম ও আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে একক আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা। চমেক ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংসদের পূর্ণ দখল ছিল আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীদের হাতে। গত বছরের ২০ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদে মনোনীত করা হয়। এরপর থেকেই চমেকে নওফেল অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছে একটি পক্ষ। নওফেল অনুসারীরা মেডিকেলে আধিপত্য বিস্তার করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরাও তাদের আধিপত্যে অন্য কাউকে ভাগ দিতে নারাজ। ফলে বারবার সংঘর্ষের ঘটছে।

আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত কলেজ ছাত্র সংসদের সহ সাধারণ সম্পাদক কাইয়ুম ইমন বলেন, ‘টেন্ডার-চাঁদাবাজির যে অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। হাসপাতাল এলাকায় চাঁদাবাজি বন্ধ করেছি। অনেক দালালকে মুক্তমঞ্চে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে হাসপাতাল ছাড়া করেছি। মুক্তমঞ্চ ও বোন্স লাইব্রেরি তৈরি করেছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংসদ। ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংসদের টাকা লুট করার ইচ্ছা থাকলে এগুলো করতো না।’

নওফেল অনুসারীরা প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে আখ্যা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কলেজ ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংসদের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় যেসব সৌন্দর্যবর্ধন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করছে, তার নামফলক কালি দিয়ে মুছে দিয়েছে তারা। আমরা চাই সহাবস্থানে থেকে যার রাজনীতি সে করুক। তারা সেটা চাইছে না। তারা একক আধিপত্য বিস্তার করতে আমাদের জুনিয়রদের ওপর বারবার হামলা করছে।’

নওফেল অনুসারী হিসেবে পরিচিত চমেকের ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘চমেক ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংসদের নাম ভাঙ্গিয়ে তারা (নাছির গ্রুপ) লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে আসছে। আমরা এসবের প্রতিবাদ করলেই তারা আমাদের ওপর হামলা করে। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে কোনো বৈধ কমিটি নেই। ওদের (নাছির গ্রুপ) সবকিছুই অবৈধ।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!