কোটি টাকার উন্নয়ন গিলে খাচ্ছে মোহরার অবৈধ বাজার-গাড়ির স্ট্যান্ড

নরক যন্ত্রণায় ভোগা আরাকান সড়কটির উন্নয়নে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রায় ৭২ কোটি টাকা ব্যয় করলেও তার পুরোপুরি সুফল মিলবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে আরকান সড়কের উন্নয়ন কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও যেসব স্থানে কাজ শেষ হয়েছে তা এখনও অবৈধ দখলদারদের কব্জায় রয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানার মোহরা ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত বর্ধিত অংশ এখনও অবৈধ দখলদারমুক্ত হয়নি।

আরকান সড়কের এই অংশ থেকে অবৈধ বাজার, টেম্পো-সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড ও ভ্যান গাড়ি উচ্ছেদে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও একমত। তবে কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও ‘ফ্রি রোড, ক্লিন ফুটপাত’ নিশ্চিত করা যায়নি এখনও। এ নিয়ে এলাকার জনগণের প্রশ্ন, কোটি টাকা খরচ করে সড়ক বড় করে লাভ কি— তা যদি অবৈধ দখলদারদের কব্জাতেই থাকে?

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৪ জুলাই ৭১ কোটি ৫৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ১২ লটে ১২ ঠিকাদারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করছে। যদিও গত ডিসেম্বরের মধ্যে এই সড়কের উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত মেয়াদে তা শেষ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। যদিওবা সিডিএর জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজের কারণে সিটি করপোরেশনকে অনেক স্থানে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে সিডিএর অনুরোধেই।

ওই প্রকল্পের অধীনে আধুনিক ‘বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)’ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার কথা সিটি করপোরেশনের। প্রকল্পের উদ্বোধনের সময় মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেছিলেন, ‘এ সড়কের উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হলে ভারি বর্ষণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতাসহ জনসাধারণের কষ্ট লাঘব হবে এবং যানজট অনেকাংশে নিরসন হবে। প্রকল্পের আওতায় সড়কের উভয় পাশে প্রশস্তকরণ, ড্রেন নির্মাণ, দৃষ্টিনন্দন ফুটপাত, আলোকায়নসহ সৌন্দর্য্য বর্ধন করা হবে। এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারী উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রায় ৫ লাখ মানুষ উপকৃত হবে।’

মোহরায় সড়কের ওপর বাজার।
মোহরায় সড়কের ওপর বাজার।

ওই সময় বলা হয়েছিল, সংস্কারের পাশাপাশি এ সড়কে প্রয়োগ করা হবে আধুনিক বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) পদ্ধতি। আরকান সড়কে চলাচল আধুনিক, দ্রুত ও আরামদায়ক করতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। পুরা সড়কটি ৪ অংশে ভাগ করা হবে। একটিতে গণপরিবহন যাবে আরেকটি দিয়ে ফেরত আসবে। বাকি দুটির একটি দিয়ে মোটরবিহীন গাড়ি চলবে আর চতুর্থ লেনটি সব গাড়ির জন্য উন্মুক্ত থাকবে বলেও জানান মেয়র।

সিটি করপোরেশন, ট্রাফিক বিভাগ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ প্রকল্পের ১২৩ লটের মধ্যে মোহরা অংশে দুই লটের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে হওয়ায় সড়কও প্রশস্ত হয়েছে। আগের থেকে সড়ক ও ফুটপাত বাড়লেও বর্ধিত অংশের সেই সুবিধা পাচ্ছে না জনগণ। বিশেষ করে কাপ্তাই রাস্তার মাথায় অবৈধ সিএনজি অটোরিকশার স্ট্যান্ড, ভ্যান গাড়ি বসিয়ে সড়ক দখলের মাধ্যমে যানজট সৃষ্টি, রাস্তার মাথা থেকে মৌলভী বাজার পর্যন্ত ফুটপাত দখল করে দোকানদাররা তাদের সামগ্রী রাখা, বিশেষ করে কাজীরহাট কামাল বাজার এলাকায় সড়ক দখল করে ভ্যান গাড়ি বসানো ও রাস্তার মাথায় ভ্যান গাড়ি বসানোর কারণে সড়ক বর্ধিতকরণের সেই সুফল মিলছে না। প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে।

বিষয়টির সমাধানে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ থেকে একাধিকবার পরিদর্শন করে উচ্ছেদ চালানো হলেও পরের দিনই একই রূপ নেয় সড়কের। এছাড়া সম্প্রতি সিটি করপোরেশন ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে ফুটপাত দখলমুক্ত করলেও পরের দিনই সেই আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। এছাড়া সিটি করপোরেশন আরকান সড়কে কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে কাজীর হাট পর্যন্ত প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাট বসলেও বর্তমানে সিটি করপোরেশন গত অর্থ বছর থেকে এই অস্থায়ী হাটের ইজারাও বাতিল করেছে।

কোটি টাকার উন্নয়ন গিলে খাচ্ছে মোহরার অবৈধ বাজার-গাড়ির স্ট্যান্ড 1

এরপরও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি মহল সিটি করপোরেশনের নাম ভাঙিয়ে প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার ও শুক্রবার আরকান সড়কের ওপর হাট বসিয়ে টাকা আদায় করছে। সিটি করপোররেশন রাজস্ব বঞ্চিত হলেও প্রভাবশালীদের পকেটে ঢুকছে হাজার হাজার টাকা। আর এই সড়ক ব্যবহারকারীরা পড়ছেন দুর্ভোগে। ওই সড়কে লেগে থাকে নিত্য যানজট।

গত সপ্তাহে সড়কটির অবৈধ স্থাপনা ও অবৈধ টেম্পো-সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে ফ্রি রোড ও ক্লিন ফুটপাত নিশ্চিত করতে ট্রাফিক বিভাগকে অনুরোধ করেন স্থানীয় তরুণ সংগঠক ও সমাজকর্মী আলম দিদার। তার অনুরোধে সাড়া দিয়ে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের একটি দল আরকান সড়কের মোহরা অংশ পরিদর্শন করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে পদক্ষেপ নেয়। তবে তিনদিনের সময় দিয়ে অবৈধ সব স্থাপনা গাড়ির স্ট্যান্ড সরিয়ে নিতে বলা হলেও তা এখনও বহাল রয়েছে।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আলম দিদার বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশকে নিয়ে বিষয়টির সরেজমিন পরিদর্শনের পর তাদের সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা এসবকে পাত্তাই দিলও না। এখনও সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমি মেয়র নাছির ভাই ও এডিশনাল কমিশনার (ট্রাফিক) ও ডিসিকে (ট্রাফিক) অনুরোধ করেছি। সকলেই বলেছেন, ফ্রি রোড, ক্লিন ফুটপাত তারা করবেনই।’

মোহরা মুজিব সৈনিকের সভাপতি আসফাক হোসাইন খান বলেন, ‘কোটি টাকা খরচ করে সিটি করপোরেশন সড়ক উন্নয়ন করে লাভ কী? যদি সেই সড়কই আবার দখল হয়ে যায়। আমরা আশা করবো খুব দ্রুত অভিযান চালিয়ে এসব দখলদারদের উচ্ছেদ করে জনগণের সুবিধার্থে সড়ক ও ফুটপাত উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে সরেজমিন পরিদর্শনে যাওয়া সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের (চান্দগাঁও) পরিদর্শক সুশান্ত কুমার দাস বলেন, ‘আমরা যখন পরিদর্শন করেছি তখন রাস্তার মাথা, কাজীর হাট ও কামাল বাজারের সড়কে থাকা ভ্যান গাড়িগুলো সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছি। একই সাথে ওইদিন ৬টি ভ্যানগাড়িও জব্দ করেছি। যখন কাজীর হাটের বাজার উচ্ছেদ করতে গেছি তখন তারা জানিয়েছিলেন, এটা সিটি করপোরেশনের থেকে ইজারা নেওয়া বাজার।’

তিনি আরও বলেন, ‘একথা শুনার পর যখন আমরা সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ ও এস্টেট বিভাগে খোঁজ নিলাম। তখন সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়েছে, গত অর্থ বছর থেকে সিটি করপোরেশন থেকে কাজীর হাটে কোনও বাজার ইজারা দেওয়া হয়নি। যারা এসব করছে তা অবৈধভাবে করছে।’

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মোস্তাক আহমেদ খান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মোহরায় সড়কের ওপর সিটি করপোরেশনের কোনও বাজার ইজারা দেওয়া হয়নি বলে আমাদের জানিয়েছে। তাই রাস্তার মাথা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত কোনও বাজার বসতে দেওয়া হবে না। এছাড়া অবৈধ গাড়ির স্ট্যান্ড ও ভ্যানগাড়ি সড়কে বসতে দেওয়া হবে না। এই সপ্তাহের মধ্যেই সিটি করপোরেশনকে সাথে নিয়ে আমরা অভিযানে যাব।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মোহরায় সড়কের ওপর কোনও বাজার আমরা ইজারা দিইনি। এছাড়া কোটি কোটি টাকা খরচ করে যেখানে সড়ক বড় করছি সেখানে অবৈধ স্থাপনা থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা এর আগে উচ্ছেদ করেছি। সামনেও করবো। যখনই ট্রাফিক বিভাগ সহযোগিতা চাইবে, আমরা করবো।’

এডি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!