কেন নিখোঁজ হয়েছিলেন আশরাফ মাহদী, কেনই বা ফিরে দেওয়া হল?

মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আশরাফ মাহদীর বাবা মাওলানা জসিম উদ্দিন দুদিন আগেও বলছিলেন, ‘এখন পর্যন্ত পুলিশের তৎপরতায় আমি সন্তুষ্ট। আমার সঙ্গে তাদের সার্বক্ষণিক কথা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, খুব শিগগিরই আশরাফ মাহদী আমাদের কাছে ফিরে আসবে।’

শেষ পর্যন্ত ফেসবুকে লিখবেন না— এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন আশরাফ মাহদী। তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুল হক আমিনীর নাতি। গত ৬ আগস্ট রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন। ঠিক যেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, অপহরণকারীরা দুদিন পর সেখানেই তাকে ফেলে যায়।

আশরাফ মাহদীর বাবা মাওলানা জসিমউদ্দীন মনে করেন, যাদের হস্তক্ষেপে আশরাফ মাহদীকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তারাই তার ছেলেকে অপহরণ করেছিলেন। গত ৬ জুলাই রাতে তিনি লালবাগে তার নানীর সঙ্গে দেখা করে রিকশায় ফিরছিলেন। রাত ১১ টা ২৭ মিনিটে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দেন তাকে কেউ অনুসরণ করছে। তার কিছু হলে দায়ী হবেন ফয়জুল্লাহ-আলতাফ গং। এরপর তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময় আশরাফের অবস্থান ছিল ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে। ৮ জুলাই বেড়িবাঁধের কাছেই অপহরণকারীরা ঠিক সেখানেই তাকে ফেলে রেখে যায়।

ফেসবুকে না লেখার শর্তে মুক্তি মিললেও শনিবার (৮ আগস্ট) ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে আশরাফ মাহদী লিখেছেন, ‘মানসিকভাবে ঘটনা লেখার মত অবস্থায় আমি নেই। তবে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে সবাই একটা প্রশ্নই করছেন। আমি স্ট্যাটাস কিভাবে দিলাম? তারা খুব পেশাদার কেউ ছিল বলে আমার মনে হয়নি। আমাকে ধরার প্রায় দশ মিনিট আগেই তারা বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা আমাকে ফলো করছে। তখনই আমি স্ট্যাটাস লিখে ফেলি। এবং রিকশা থেকে নামার আগেই পোস্ট দিয়ে ফেলি। যদি তারা আমাকে না ধরতো তাহলে পোস্ট সরিয়ে দিতাম। দুইদিন তারা আমাকে একটা কথাই বুঝিয়েছে, ফেসবুকে লেখালেখি বন্ধ করতে হবে। লেখালেখি না করার শর্তেই আজ মুক্তি পেয়েছি।’

মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহদী সম্প্রতি দেশে আসেন। চট্টগ্রামের একটি মামলায় গ্রেফতারও হন এবং জামিন পান। এরপর হঠাৎ করে নিখোঁজ হন এবং নিখোঁজ হবার আগে ইসলামী ঐক্যজোটের একাধিক শীর্ষ নেতাকে এর জন্য ‘দায়ী’ করেন।

গত ৬ আগস্ট রাতে আশরাফ মাহদী নানীর (মুফতি ফজলুল হক আমিনীর স্ত্রী) সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফেরার সময় লালবাগ কেল্লার সামনে থেকে নিখোঁজ হন। রাত ১১টা ২৭ মিনিটে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের নিখোঁজের কথা বলেন আশরাফ। সেখানে তিনি লিখেছেন, তার কিছু হলে ফয়জুল্লাহ-আলতাফ গংকে দায়দায়িত্ব নিতে হবে। এই ঘটনার পর ইসলামী দলগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেছেন, ‘আশরাফ মাহদী আমার ছেলের মতো। ওর বাবা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে রাজনীতি করি। কেন সে এই অভিযোগ করল সেটা বুঝতে পারছি না। ও নিখোঁজ হওয়াতে আমরাও উদ্বিগ্ন ছিলাম।’

এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামীর সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘আশরাফ মাহদীর ঘটনার সঙ্গে হেফাজতের কোন সম্পর্ক নেই। আসলে ইসলামী ঐক্যজোটের মধ্যে আমিনী সাহেবের পরিবারের সদস্যদের বিরোধ থেকেই আলোচনায় এসেছেন আশরাফ মাহদী। আমিনী সাহেবকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে— এমন অভিযোগ তুলে আশরাফ যখন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তখনই বিবাদের শুরু। এরপরই আমিনীর পরিবার দুই ভাগ হয়ে যায়। এক গ্রুপে আছেন ইসলামী ঐক্যজোটের বর্তমান মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, আমিনী সাহেবের ছেলে হাসনাত, সাবেক খাদেম মাওলানা আলতাফ। আর অন্য গ্রুপে আছেন আমিনী সাহেবের দুই জামাই যারা লালবাগ মাদ্রাসায় আছেন। আশরাফ মাহদীর বাবা মাওলানা জসিম উদ্দিন, মাওলানা মুফতি সাখাওয়াত হোসেন ও মাওলানা জুবায়ের।’

তবে নিখোঁজ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে এসে আশরাফ মাহদী ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে জানিয়েছেন, ‘আমাকে হয়রানি করার বিষয়টি মোটেও পারিবারিক দ্বন্দ্ব নয়। এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপার। দেশবরেণ্য ওলামায় কেরাম ও সচেতনমহল এ বিষয়টি ভালভাবে জানেন বলেই শক্ত ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন।’

জানা গেছে, গত জুলাইয়ের শুরুতে ফেসবুকে আশরাফ মাহদী একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি অভিযোগ আনেন মুফতি আমিনীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যার জন্য মুফতি ফয়জুল্লাহ ও আলতাফসহ কয়েকজনকে দায়ী করেন তিনি। এছাড়া কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের বৃহৎ বোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ এর বেশ কিছু দুর্নীতির অভিযোগ করেন৷

পরবর্তিতে মুফতি আমিনীর ছেলে আবুল হাসনাত আমিনী (যিনি আশরাফ মাহদীর আপন মামা) তিনিসহ আরও কয়েকজন ফেসবুক লাইভে এসে এসব অভিযোগ ‘অমূলক’ বলে উল্লেখ করেন। এরপরই বিষয়টি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

কয়েকদিন পর ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ছাত্র খেলাফত চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি মাওলানা ওসমান কাসেমের ওপর অজ্ঞাত পরিচয় কিছু যুবক হামলা করে। যে হামলার পর ১৯ জুলাই তাদের রক্তাক্ত ছবি সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় ওসমান কাসেম একটা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়। নাম উল্লেখ করা সর্বশেষ অর্থাৎ ৯ নম্বর আসামি হিসেবে হাফেজ মাওলানা আশরাফ মাহদীর নাম বলা হয়েছে। এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ২৮ জুলাই আশরাফ মাহদীকে আদালতে তোলা হয়। আদালত তার জামিন দেন। এরপর থেকে তিনি বাসাতেই ছিলেন।

আশরাফ মাহদীর বাবা মাওলানা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি পাওয়ার পর ৪ জুলাই আমার ছেলে মিশর থেকে দেশে আসে। ২৫ জুলাই তার ফিরে যাওয়ার কথা। এর মধ্যে সে ফেসবুকে কিছু স্ট্যাটাস দেয় যা অনেককেই কষ্ট দিয়েছে, যদিও সে সন্দেহের কথা বলেছে। তারপরও বিষয়গুলো মিটমাট হয়ে যায়। ২৫ জুলাই সকালে সে মিশরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করে। ট্রান্সজিট হিসেবে দুবাই নামার পর সেখানে ইমিগ্রেশন তাকে জানায়, ওয়ান্টেড হিসেবে বাংলাদেশ তাকে ফেরত পাঠাতে বলেছে। সে সেখানে অবস্থানের চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায় থেকে চাপ দেওয়ায় দুবাই ইমিগ্রেশন তাকে ২৭ জুলাই দুপুরে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। রাতে পৌঁছার পর বিমানবন্দরে বসিয়ে রেখে সকালে চট্টগ্রাম নিয়ে যায়। সেখানে আদালতে তুলতে আদালত জামিন দেন। এরপর থেকে সে বাসায়ই ছিলো। কিন্তু ৬ আগস্ট রাতে সে নিখোঁজ হয়ে যায়।’

আশরাফ মাহদীকে কি দুবাই থেকে ফেরত আনা হয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে চান্দগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমরা তাকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করেছি, বিদেশ থেকে ফেরত আনার বিষয়টি ঠিক নয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!