কেন ঘটে এসির বিস্ফোরণ, কিভাবে বিপদ এড়ানো সম্ভব?

নারায়ণগঞ্জের মসজিদে একসঙ্গে ছয়টি এয়ার কন্ডিশনার বা এসি বিস্ফোরিত হওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন ৩৬ জন মুসল্লি। এর মধ্যে এক কিশোর মারা গেছে। অন্যদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। দগ্ধদের সবারই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। রোগীদের সবারই শরীরের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে। অনেকের শরীরের ৬০-৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এয়ার কন্ডিশনার বা এসির ব্যবহার বাড়ছে, তেমনি প্রায়ই এসি বিস্ফোরণের ঘটনার কথাও শোনা যাচ্ছে। স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে এসির বিকল্প নেই ঠিকই, কিন্তু এই এসি থেকেও যেকোনো সময়ে ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বড় ক্ষয়ক্ষতিও হতে পারে এসির বিস্ফোরণ থেকে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় সেটিই আরেকবার প্রমাণিত হল। এরকম দুর্ঘটনা সম্পর্কে সজাগ হওয়ার সময় এসেছে। শুধুমাত্র সচেতনতাই পারে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে।

কেন ঘটে এসির বিস্ফোরণ?
প্রকৌশলীদের মতে, এসি দুর্ঘটনার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। অনেকে রুমের লোড অনুপাতে এসি ব্যবহার করেন না। ফলে এসিটি অনেকক্ষণ ধরে চলতে হয়, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। নিম্নমানের এসি কিনলে সেগুলোর ভেতরে ফ্যান, তারের, বিদ্যুতের ব্যবস্থাগুলো ঠিক থাকে না। ফলে সেখানেও কারিগরি ত্রুটি দেখা যায়, যা অনেক সময় আগুনের সূত্রপাত করতে পারে।

এসি দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। ফলে কারিগরি ত্রুটির কারণে এসিতে আগুন ধরে যেতে পারে বা এসির গ্যাসে আগুন লেগে সেটি ঘরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক সময় উইন্ডো এসির সামনে জানালা বা দরজার পর্দা চলে এলে বাতাস চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়। সেটিও এসিকে গরম করে তুলতে পারে।

আরও কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে, সেগুলো জানা যাক—

১. অনেক সময় কম্প্রেসারের ভেতরে জ্যাম লেগে থাকে। এতে গ্যাস লিক হয়ে যায়। এই জ্যাম আর লিক সময়মতো সার্ভিসিং করাতে না পারলে ঘটতে পারে বিস্ফোরণ। এছাড়া এসির ফিল্টার নিয়মিত পরিষ্কার না করলেও ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।

২. নিম্নমানের গ্যাসও এসি বিস্ফোরণের অন্যতম একটি কারণ। বর্তমানে প্রচলিত এসিগুলোয় যে গ্যাস ব্যবহার করা হয়, সেই গ্যাসে সহজে আগুন ধরে যায়। ফলে কোন কারণে সেটি লিক হয়ে জমে থাকলে, সেখানে বৈদ্যুতিক কারণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হলে বা ম্যাচের কাঠি জ্বালানো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে।

৩. কোনো কারণে এসির প্রেসার বেড়ে গেলে কম্প্রেসার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। কখনো আবার দাহ্য গ্যাসের কারণেও এসি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে।

৪. বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৈদ্যুতিক হাই ভোল্টেজের কারণে এসব ঘটনা ঘটে। হাইভোল্টেজের কারণে যেকোনো ইলেক্ট্রিক মেশিনের ওপর চাপ সৃষ্টি হলেই সেখানে সমস্যা হয় এবং একসময় বিস্ফোরণের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।

৫. বজ্রপাতের কারণেও অনেক সময় এসি বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

যেভাবে এড়াবেন এসির দুর্ঘটনা
১. দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এসি চালু রাখবেন না। দীর্ঘক্ষণ ধরে এসি চললে যন্ত্রপাতি অতিরিক্ত গরম হয়ে আগুন ধরে যেতে পারে। বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে অন্তত এক-দুই ঘণ্টা এসিকে বিশ্রাম দিন।

২. বছরে অন্তত একবার পেশাদার টেকনিশিয়ান দ্বারা এসির সার্ভিসিং করানো উচিত। কারণ মেকানিক্যাল বা ইলেকট্রিক্যাল ফল্টের কারণে যেকোনো সময়ে আগুন ধরে যেতে পারে আপনার এসি থেকে। তাই টেকনিশিয়ান দ্বারা চেক করিয়ে রাখুন আপনার এসির কানেকশনে কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা। বিশেষ করে শীতের সময় দীর্ঘ কয়েক মাস বন্ধ থাকার পরে গরমের আগে আবার চালু করার আগে অবশ্যই সার্ভিসিং করে নেয়া উচিত।

৩. ফিল্টার পরিষ্কার রাখতে হবে। খেয়াল রাখবেন যে এসির ভেতর কিছু যেন জমাট বেঁধে না থাকে। আপনার এয়ার কন্ডিশনারের এয়ার ফিল্টার নিয়মিত পরিষ্কার করুন বা যদি আপনার পুনঃব্যবহারযোগ্য ফিল্টার থাকে তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তা পরিবর্তন করুন।

৪. ওয়্যারিং পর্যবেক্ষণ করুন নিয়মিত। এয়ার কন্ডিশনারে কাজ করার আগে অবশ্যই বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে নিন। এটি আপনার বাড়ির প্রধান ব্রেকার প্যানেল থেকে করা যাবে। প্রথমে আপনার কেন্দ্রীভূত ইউনিটে অ্যাক্সেস প্যানেলটি সরান এবং ওভারহিটিং এর কোনো লক্ষণ আছে কিনা দেখুন। এছাড়াও তারের ওপর গলিত আস্তরণ, কালো বা জ্বলন্ত কিছু খুঁজে পেলে সাথে সাথে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। ভেতরের সবগুলো তারের সংযোগ টাইট করে লাগানো কিনা দেখে নিন।

৫. বৈদ্যুতিক হাই ভোল্টেজ এড়ানোর জন্য ভবনগুলোর ছাদে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা রাখুন।

৬. নকল এসি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। অনেক সময় নিম্নমানের ও মানহীন যন্ত্রাংশ এসব নকল এসিতে ব্যবহার করে বিখ্যাত কোনো এসির নাম ও লোগো দিয়ে বাজারে বিক্রি করা হয়। তাই এসি কেনার সময় অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বণ করতে হবে।

৭. গরমের শুরুতে এসির বৈদ্যুতিক সংযোগ, সকেট, ফিল্টার— এসবের অবস্থাটা ঠিকমতো পরীক্ষা করতে হবে। অনেক দিন বন্ধ থাকার পর চালু করতে গেলে অবশ্যই এসির সংযোগ তার পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। অনেক দিন বন্ধ থাকার কারণে চালু করলে এসির ভেতরে শব্দ হতে থাকে।

৮. একনাগাড়ে আট ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। এছাড়া আউটডোর মেশিন এমন স্থানে বসাতে হবে, যেন পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!