কেডিএসের রোষে পড়া সাবেক কর্মকর্তা জানালেন হয়রানির করুণ কাহিনী

৯ মাসে দেওয়া হল ২৮ মামলা, জেলেও এক বছর

যার হাত ধরে একটি প্রতিষ্ঠান উন্নতির শিখরে উঠেছে, তার হাতেই ধরিয়ে দেওয়া হল একের পর এক ২৮টি মামলা। যে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার প্রসারে দিন-রাত কাটাতেন কারখানা কিংবা অফিসে, সেই প্রতিষ্ঠানেরই কর্তাব্যক্তির রোষানলে পড়ে বিনা বিচারেই তাকে একটি বছর কাটাতে হয়েছে কারাগারের ভেতরে। কোনো মামলায় যখনই তিনি জামিন পান, তখনই তার নামে দেওয়া হয় নতুন মামলা।

চট্টগ্রামভিত্তিক কেডিএস গ্রুপের মালিকানাধীন কেওয়াই স্টিল মিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মুনির হোসেন খান কেডিএস গ্রুপের দায়ের করা ২৮টি মামলা মাথায় নিয়ে কারাগারে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে এসেছেন।

জামিনে আসার পর তিনি কেডিএস গ্রুপের করা বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে তার বক্তব্য জানিয়েছেন। বলেছেন তার নিজের এবং পরিবারের করুণ সব ঘটনা। তিনি অভিযোগ করেছেন, কেডিএস গ্রুপ শুধু টাকার জোরে বিভিন্ন জায়গায় প্রভাব খাটিয়ে তার বিরুদ্ধে মাত্র নয় মাসে দিয়েছে ২৮টি মামলা। বিনাবিচারে তাকে এক বছর জেলও খাটতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের দ্বিতীয় ছেলে বিদেশি নাগরিককে খুন করে যাবজ্জীবন সাজা খাটা ইয়াসিন রহমান টিটুর হাতে মুনিরকে খেতে হয়েছে কিল-ঘুষি-লাথিও।

মুনির হোসেন খান বলেন, ‘বন্ধুর অনুরোধে ২০০৭ সালে ব্যাংক অব আমেরিকা ফ্লোরিডার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে কেডিএস গ্রুপে যোগ দিয়েছিলাম। প্রায় ১১ বছর রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে কেডিএসের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কে ওয়াই সিআর কয়েল ইন্ডাষ্ট্রিজ এবং কেওয়াই স্টিল লিমিটেডকে দেশের শীর্ষস্থানীয় ঢেউটিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছি। বিনিময়ে জুটেছে ৯ মাসে ২৮টি মামলা এবং এক বছরের জেল।’

মুনির হোসেন খান বলেন, ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল কোম্পানির ডিএমডি ইয়াছিন রহমান টিটু কর্তৃক মারধরের শিকার হয়ে চাকরি ছাড়ার পর তিনি তাদের রোষানলে পড়েন।

টাকার জোরের কাছে তিনি বিপন্ন উল্লেখ করে বলেন, গত ২৮ নভেম্বর কেডিএস গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কে ওয়াই স্টিলের পক্ষে তাদের চিফ অপারেশন অফিসার জাবির হোসাইন সাংবাদিক সম্মেলন করে ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনেন। শুধু তাই নয় চাকরি ছাড়ার ২০ মাস পর ২০১৯ সালের নভেম্বর নজিরবিহীনভাবে ৯ মাসে ২৬টি মামলা ক্রিমিনাল ও দুইটি সিভিল মিথ্যা মামলা করেছে। আইনের অপব্যবহার করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমার বিরুদ্ধে একেক সময় একেক ধরনের কুৎসাও রটাচ্ছে— যা বিভ্রান্তিমূলক ও মানহানিকর।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রথম মামলা ছিল গাড়ি চুরি ও হত্যা চেষ্টা। বায়েজিদ থানায় দায়েরকৃত মামলাটিতে যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে সে সময় তিনি ঢাকায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ছিলেন। ওই মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এরপর একবছর জেলে ছিলেন। সম্প্রতি মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ। অর্থাৎ অভিযোগ মিথ্যা।

মুনির খান বলেন, তাদের আরেকটি অভিযোগ হল এইচআর কয়েল আমদানিতে গোপন চুক্তির মাধ্যমে ৬০০ কোটি টাকা কমিশন খাওয়া। যা হাস্যকর। এত টাকা কোনো ব্যক্তির কাছে থাকলে তা কোনো না কোনো সরকারি সংস্থার চোখে পড়বেই। দেশে কিংবা বিদেশে আমার এবং আমার পরিবারের এই ধরনের কোনো সম্পত্তি নেই। তাছাড়া অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে পণ্য আমদানি করলে কাস্টমস এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কেওয়াই স্টিলকে টাকা পাচারের অভিযোগে অনেক আগেই ব্যবস্থা নিত।

মুনির খান দাবি করেছেন, বর্তমান কেওয়াই স্টিলের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) জাবির হোসাইন বিভিন্ন জাল ও ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করেই কেডিএস কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করে নিজে ফায়দা লুটছে। কারণ কমিশন খাওয়ার অভিযোগ করলেও ওই কমিশন কোন্ ব্যাংকের মাধ্যমে খেলাম বা কোথায় রাখলাম তার কোন তথ্য নেই। তিনি যে চুক্তি দেখাচ্ছেন তা জাল এবং অসম্পূর্ণ। কে ওয়াই স্টিলের সংবাদ সম্মেলনে জাবির হোসাইন একটি অনলাইন মার্কেটিং কোম্পানি থেকে বাজারমূল্যের বেশি দামে পণ্য কেনার অভিযোগ তুলেছেন। বাস্তবে আমার কাছে সে সুযোগ ছিল না। কারণ কেডিএসের ব্যাংক একাউন্ট থেকে সরাসরি রপ্তানিকারককে টাকা দেওয়া হয়েছে এলসির মাধ্যমে। অন্যদিকে যে বাজারমূল্য প্রদর্শন করছে তাও সঠিক নয়। অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সারাবিশ্বের স্ট্যান্ডার্ড এইচ আর কয়েলের একটি সম্ভাব্য বাজারমূল্য দিয়ে থাকে। কিন্তু কিনতে গেলে গুণগত মান, থিকনেস এবং দেশের দূরত্ব ইত্যাদি বিবেচনায় দামের কম-বেশি হয়। এর সাথে ভাড়া ও অন্যান্য খরচও যোগ হয়। তাই যে সংস্থাটি বাজারমূল্য দিয়ে থাকে তাদের ওয়েবসাইটেই বিষয়টি লেখা থাকে যে মূল্য তারা প্রদর্শন করছেন তা শুধু মার্কেট সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া। প্রকৃত মূল্য ভিন্ন হতে পারে। অথচ জাবির হোসাইন ওই ওয়েবসাইটের মূল্য দেখিয়ে আমার বিরুদ্ধে এত বড় একটি মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আমি যে সময়ে এইচ আর কয়েল আমদানি করেছি তখন চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের আরো অনেক কোম্পানি এইচআর কয়েল আমদানি করেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের সেই সময়ের তথ্য যাচাই করলে আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে। এটি একটি খুবই ভোলাটাইল আমদানিকৃত পণ্য যা প্রমাণ আকারে দেখানো যাবে।

কেডিএস এখন নতুনভাবে হয়রানি করছে— এমন অভিযোগ করে মুনির হোসেন খান বলেন, তার বাবা চট্টগ্রাম বন্দরের একজন অবসরপ্রাপ্ত হারবার মাস্টার। বড়পুল এলাকায় তার বাবা ইসাবেলা টাওয়ার নামে একটি ভবন করেছেন, তাও তিনি কে ওয়াই স্টিলে যোগদানের আগে। তিনি তার দীর্ঘ ১৭ বছর আমেরিকার জীবনে অনেকবার বাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ও করেছেন। তার প্রমাণাদিও কাছে উল্লেখ করে মুনির খান বলেন, কেডিএস সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে তার পরিবার থেকে কেউ যাতে কোন স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি না কেনে— যা সম্পূর্ণ মানহানিকর এবং বেআইনি। কারণ এ সংক্রান্ত আদালতের কোনো নির্দেশনা নেই।

মুনির খান অভিযোগ করে বলেন, জাবির হোসাইন কিছু ভুয়া চুক্তিপত্র, আমার স্বাক্ষর এবং বিদেশি স্বনামধন্য কোম্পানির স্বাক্ষর জাল করে ফটোকপির মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা দিয়ে হয়রানি এবং নাজেহাল করেছে। একটি মামলা থেকে জামিন হওয়ার আগেই আরেকটি মামলা দিয়ে আমাকে আটক রাখছে।

মুনির খান বলেন, কেডিএস তার মাসিক বেতন, সন্তানদের লেখাপড়া, বিদেশ ভ্রমণ এবং ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। বেতন কোথাও দুই লাখ টাকা, আবার কোথাও তিন লাখ টাকা উল্লেখ করেছে। এর কোনোটাই সত্য নয়। অন্যদিকে তারা প্রশ্ন তুলেছে, আমার মেয়ে কিভাবে ব্যয়বহুল ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে লেখাপড়া করছে। অথচ আমার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ কেডিএস কর্তৃপক্ষই বহন করেছে। এই সকল কিছুরই তথ্যপ্রমাণ আমার কাছে আছে।

তিনি বলেন, আমদানিকৃত মালামাল বন্দর থেকে ক্লিয়ারিং করে কেডিএসেরই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে একই পণ্য খালাস করছে। দেশের প্রখ্যাত অডিট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিবছর এই প্রতিষ্ঠানের অডিট হতো। কোন ধরনের আর্থিক অনিয়ম ঘটে থাকলে অডিট আপত্তি আসত। তাছাড়া মাসিক অভ্যন্তরীণ অডিট রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কোম্পানির গ্রুপ অডিট এবং সিএফও তৈরি করতেন এবং তা তাদের কাছেও যেত। দীর্ঘ ১১ বছরে আমার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ কখনও আসেনি। প্রতিবছর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গ্রুপের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার এই কাজটি করতেন। সবসময় কোম্পানির ইন্টারনাল অডিট রিপোর্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অধীনেই ছিল। কখনো পরিচালক অথবা সিইও-এর অধীনে ছিল না।আমি সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে ৩০০ কোটি টাকার মূলধনের কোম্পানিকে ১৩০০ শত কোটি টাকার কোম্পানিতে পরিণত করেছি।

মুনির হোসেন খান বলেন, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে আমার স্ত্রী বড় বড় শপিং মল থেকে কেনাকাটা করেছে এমন অভিযোগও তারা করেছেন। বাস্তবতা হল কোম্পানি আমাকে একটি ক্রেডিট কার্ড দিয়েছে ব্যবহার করার জন্য। এই কার্ড দিয়ে অফিসের জন্য অনেক সময় খরচ করেছি। মাঝে মধ্যে ব্যক্তিগত কোনো খরচ করলে সেটা অফিস আমার বেতন থেকে কেটে নিত। বেতন বিল যাচাই করলেই তার সত্যতা মিলবে। আমার ব্যাংক একাউন্টের তথ্যপ্রমাণ দিলেই তা বিস্তারিত প্রমাণিত হবে। অফিসের টাকায় বিদেশ ভ্রমণের অভিযোগ আনা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। যা সম্পূর্ণ অবাস্তব একটি অভিযোগ। আমার চাকরির শর্ত অনুসারে আমার পরিবারের দেশে এবং দেশের বাইরে ভ্রমণের সমস্ত খরচ কোম্পানি বহন করবে। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে কোনো কর্মকর্তার ইচ্ছেমত প্রতিষ্ঠানের টাকায় বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। কারণ বিদেশ যেতে গেলে আমাকে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চেয়ারম্যানকে জানিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের সম্মতি বা ছুটি ছাড়া কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। এটা সত্য যে, এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হয়ে অনেকবার বিদেশ গিয়েছি। তারা যেখানে পাঠিয়েছেন সেখানেই গিয়েছি। যতই কষ্ট হোক, ক্লান্তি লাগুক আমি কাজকে কখনো না করিনি। তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি ব্যবসার নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করেছি। আমার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে আজ তাদের সাথে জয়েন ভেঞ্চারে ব্যবসা করছে জাপানের বিখ্যাত একটি কোম্পানি।

তিনি বলেন, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কেডিএস গ্রুপের কেওয়াই স্টিলে কর্মরত ছিলাম— এটা সত্য। কিন্ত সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে আমি নাকি সকল ক্ষমতার অধিকারী। অথচ বাস্তবতা হল ভিন্ন। কোনো প্রাইভেট কোম্পানিতে বেতনভুক্ত পরিচালক সকল ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন না। তাই আমার কাছেও সকল ক্ষমতা ছিল তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এখন একইভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমি এবং আমার পরিবারকে চরম সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আপনাদের মাধ্যমে আমি কেডিএস কর্তৃপক্ষের কাছে এই আকুতি জানাই আমাকে যেন মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই দেন। আমি আমার পরিবার নিয়ে শান্তিতে বাঁচতে চাই।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!