‘কেউ আমাকে একটা ভাল খবর দিতে পারবেন, প্লিজ??’

ফেসবুকে ডা. আব্দুর রবের হৃদয়ছোঁয়া পোস্ট

ডা. আব্দুর রব মাসুম। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট তিনি। চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ডা. আব্দুর রব। ২৩ এপ্রিল রাত ৮টায় ফেসবুকে নিজের টাইমটাইনে ‘কেউ আমাকে একটা ভাল খবর দিতে পারবেন, প্লিজ??’ শিরোনামে একটি লেখা পোস্ট করেন। হৃদয়ছোঁয় সে পোস্টটি হুবহু প্রকাশ করা হলো। তিনি লিখেছেন,

কেউ আমাকে একটা ভাল খবর দিতে পারবেন, প্লিজ?? আজ সরকারি ছুটির দিন। নয়টা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি। ঘুম থেকে উঠে ডেলটা থেকে কল পেলাম, কভিড পেশেন্ট দেখতে হবে। পেশেন্ট দেখে নীচে নামছি, দেখতে পেলাম আইসিইউ’র সামনে এক যুবক নীরবে কাঁদছে, পরিচিত মনে হল, আমায় দেখে বলল, স্যার, আব্বা একটু আগে মারা গেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন সাহেব। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ভর্তি। অনেকবার দেখতে গিয়েছি, কেবিনে ছিলেন, পরে আইসিইউ’তে ছিলেন। একজন সত্যিকার লড়াকু মানুষ। অনেকদিন লড়াই করে আজ হেরে গেলেন কভিডের কাছে। উনার পরিবার ও লড়াই চালিয়ে গেছেন এতদিন। উনার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

গতকাল এক মাকে নিয়ে এসেছিলেন তার ছেলে আমার চেম্বারে। কভিড পজিটিভ। অক্সিজেন ৮৯! ভর্তি করাতে বললাম। চেম্বার থেকে মা বের হওয়া মাত্রই ছেলে বসে পড়ল ফ্লোরে। আমার হাত ধরে বলল, আমার বাবা নেই, মা ছাড়া আর কেউ নেই, আমার মাকে বাঁচান। সাহস দিলাম। বললাম ইন শা আল্লাহ কিছু হবে না।

ইফতারের পর এক পরিবার এর তিনজন আসল। সবাই পজিটিভ। ছয় বছরের এক বাচ্চাও পজিটিভ। মায়ের চোখে শংকা। কিছু হবেনা ত? অভয় দিলাম। ইন শা আল্লাহ কিছু হবে না।

এরকম শত শত গল্প নিয়েই দিন কাটছে আমার। এর মধ্যে একটা খবর পড়ে সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছি। সেটা হল তরল অক্সিজেন এর সংকট। গত বছর অক্সিজেন নিয়ে হাহাকার দেখেছি,, সিলিন্ডার রি-ফিল করা নিয়ে দিনরাত আতংকে থাকতাম। ভাবছিলাম, এবার সেন্ট্রাল লাইন, প্ল্যান্ট আছে। অক্সিজেন নিয়ে কোন টেনশন থাকবে না। কিন্তু বিধি বাম। গত দুই সপ্তাহ ধরে তরল অক্সিজেন রি-ফিল নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই পাওয়া যাচ্ছে না। সেদিন ভয়ে সব খালি সিলিন্ডার গুলো রি-ফিল করালাম, সিএমপির মইনুল ভাই এর সহায়তায়। যদি তরল অক্সিজেন রি-ফিল করা না যায়।

শুনেছি তরল অক্সিজেন দেশে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হয় না। ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। ভারতের কভিড সিসুয়েশন এখন সবচেয়ে খারাপ। তাদের চাহিদা বাড়ছে। এ অবস্থায় তারা আমাদের চাহিদামত দিতে পারবে কিনা? টিকার ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। কেউ নিজের ঘরের রান্না বাদ দিয়ে পাশের বাড়ির হাঁড়ি জ্বালাবে না। আমাদের চিন্তা আমাদেরই করতে হবে। কি করতে পারি, আমরা? আঠার কোটি মানুষের এই দেশে, ৭০% মানুষ কে টিকা দিতে চার পাঁচ বছর লেগে যাবে।

এদিকে করোনা ভাইরাস দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। লকডাউন ও পার্মানেন্ট কোন সমাধান নয়। এখানে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। বেশিদিন লকডাউন চললে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। কভিড চিকিৎসায় প্রতিদিন সরকারের হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এভাবে আসলে আর কতদিন চলবে? ইতিমধ্যে চিকিৎসক, নার্স আর সাস্থ্যকর্মীরা হাঁপিয়ে উঠেছে। কিছুদিন পর অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে। শুধু তাই না, আমাদের বাচ্চারা ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে, তাদেরও মানসিক সাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। তাহলে??

কি করতে হবে? আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে, আমার কাছে শুধু একটা সমাধানই আছে। তা হল, প্রিভেনশন। একমাত্র প্রিভেনশন। শতভাগ মাস্ক ব্যাবহার নিশ্চিতকরণ। কভিড চিকিৎসায় হাজার কোটি টাকা খরচ না করে, সরকারের উচিৎ সবার জন্য ফ্রি মাস্ক এর ব্যবস্থা করা। প্রতিদিন যারা মাস্ক ছাড়া বের হবে, তাদেরকে অতিদ্রুত মাস্ক সরবরাহ করা এবং প্রতিটা জায়গায় শতভাগ মানুষের মাস্ক ব্যাবহার নিশ্চিত করা। তাহলেই ৯৫ ভাগ সংক্রমণ কমে যাবে। এরকম একটি সিদ্বান্তের অপেক্ষায় আছি আমি, আমরা। কেউ কি আমায়, একটা ভাল খবর দিতে পারবেন?? অনেকদিন কোন ভাল খবর পাই না। ভাল থাকুন, সবাই।’

আইএমই/কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!