কুমিরা গুপ্তছড়া ঘাট—মালিকানার রশি টানাটানিতে নৌ পরিবহন-জেলা পরিষদ মুখোমুখি

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের প্রধান নৌ যাতায়াত রুট সন্দ্বীপ চ্যানেলের কুমিরা গুপ্তছড়া ঘাটের মালিকানা নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছে সরকারি দুই সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ। বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়া এই নৌ ঘাটের মালিকানা নিয়ে দুটি সরকারি সংস্থা কাড়াকাড়ি করলেও এই রুটে যাত্রী দুর্ভোগ নিয়ে চরম অসন্তোষ রয়েছে সন্দ্বীপের ৪ লাখ মানুষের।

গত ৬ বছর ধরে জেলা পরিষদের অধীনে থাকলেও কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটটির মালিক এখন কাগজে কলমে বিআইডাব্লিউটিএ। গত বছর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার ফেনী থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত পুরো এলাকাকে নৌ-বন্দর ঘোষণা করে। পাশাপাশি বিআইডাব্লিউটিএ’কে নৌ-ঘাটগুলো পরিচালনার দায়িত্বও দেওয়া হয়। জেলা পরিষদের সাথে যেসব ঘাট নিয়ে বিরোধ আছে তার সবগুলোর মালিকানা বিআইডাব্লিউটিএ’কে দেওয়া হয় আন্তমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে।

এ কারণে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাট নিয়ে জেলা পরিষদের সাথে পরিচালনা সংক্রান্ত চুক্তি আর নবায়ন করেনি বিআইডাব্লিউটিএ। কিন্তু জেলা পরিষদও তাদের পরিচালনা কার্যক্রম বন্ধ রাখেনি। উল্টো এ নৌ-ঘাট দখলে রাখতে মরিয়া জেলা পরিষদ। আর এজন্য মন্ত্রণালয়ে তদবিরও করছে তারা।

সোমবার (১ মার্চ) আন্তমন্ত্রণালয় তাই ফের বৈঠকে বসবে। দিনে ১ লাখ টাকা রাজস্ব দেয়া এই ঘাট দখলে রাখতে বিআইডাব্লিউটিএর সাথে রেষারেষি করলেও যাত্রীদের দুর্ভোগ দূর করতে এতদিন উদাসীন ছিল জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদ ২০১৪ সাল থেকে ঘাটটি পরিচালনা করলেও নিরাপদ নৌযান ও ওঠা-নামার কষ্ট দূর করতে পারেনি তারা।

বিভিন্ন সময়ে যাতায়াত দুর্ভোগ নিয়ে সন্দ্বীপবাসীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন আন্দোলন করা হলেও এসব বিষয়ে বরাবরই উদাসিন ছিল জেলা পরিষদ। সম্প্রতি বিআইডাব্লিউটিএর উদ্যোগে খানিকটা স্বস্তি ফিরেছে এই ঘাটে। এসব কারণে বিআইডাব্লিউটিএর অধীনে এই রুটে নৌ যাতায়াত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি আছে স্থানীয় পর্যায় থেকেও।

জানতে চাইলে বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক বলেন, ‘বিআইডাব্লিউটিএর সাথে সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে ছয় বছর ধরে কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটটি পরিচালনা করছে জেলা পরিষদ। কিন্তু ২০২০ সালের ১ মার্চ ফেনী জেলার সোনাগাজী মৌজায় মুহুরী প্রজেক্ট সংলগ্ন নদী তীরবর্তী অংশ থেকে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানাধীন দক্ষিণ কাট্টলী মৌজায় রাসমনি ঘাট পর্যন্ত আড়াআড়ি ভাবে মীরসরাই-রাসমনি নদী বন্দর ঘোষণা করে সরকার। একই দিন এসআরও নং-৬৩-আইন/২০২০ এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডাব্লিউটিএ) এই নদী বন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করে।’

বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম এই প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এ ব্যাপারে আন্তমন্ত্রণালয়েও বৈঠক হয়। আমরা তাই জেলা পরিষদের সাথে ডিসেম্বরে আর চুক্তি নবায়ন করিনি। এখন আইন অনুযায়ী এটি পরিচালনা করবো আমরা।’

এই বিষয়ে জেলা পরিষদের বক্তব্য জানতে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাব্বির ইকবাল বলেন, ‘ঘাটের মালিকানা নিয়ে বিআইডাব্লিউটিএর সাথে আমাদের সমঝোতা চুক্তি আছে। এখন এটি কিভাবে পরিচালিত হবে তা মন্ত্রণালয়ই ঠিক করবে। এই ঘাটে আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ আছে। আমাদের একাধিক প্রকল্প চলমান আছে এখনো। এ বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনবে মন্ত্রণালয়।’

ঘাটের মালিকানা নিয়ে সরকারি দুই সংস্থা এভাবে কাড়াকাড়িতে লিপ্ত হলেও যাত্রী পারাপারে দুর্ভোগ নিরসনে কেউই দায়িত্ব না নেয়ায় ক্ষোভের কথা জানিয়ে সন্দ্বীপের বাসিন্দা ও বেসরকারি একটি কলেজের প্রভাষক ফছিউল আলম বলেন, ‘জেলা পরিষদ প্রতিদিন লাখ টাকা ইজারা নেওয়া ছাড়া কিছুই করেনি। নিরাপদ কোনো নৌযান দিতে পারেনি তারা। ওঠা-নামার দুর্ভোগও দূর করতে পারেনি তারা। অথচ প্রতিদিন যাতায়াত করা চার-পাঁচ হাজার মানুষের পকেট থেকে রাজস্বের নামে লাখ টাকা নিয়ে গেছে তারা।’

জানা গেছে, এক সময় কুমিরা-গুপ্তছড়া টার্মিনাল জেটিঘাট বিআইডাব্লিউটিএ ইজারা প্রদান করতো। ২০১৩ সালে ঘাটটির ইজারা নিয়ে বিআইডাব্লিউটিএ ও জেলা পরিষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। জটিলতা নিরসনে তৎকালীন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের উদ্যোগে স্থানীয় দুই সাংসদ (চট্টগ্রাম ৩ ও চট্টগ্রাম ৪), বিআইডাব্লিউটিএ ও জেলা পরিষদ-চট্টগ্রাম এর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

উক্ত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামস্থ সীতাকুণ্ড ও সন্দ্বীপ উপজেলার অন্তর্গত কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরীঘাট পরিচালনা নিয়ে বিআইডাব্লিউটিএ ও জেলা পরিষদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৬ বছরের সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী বার্ষিক টার্মিনাল ও গ্যাংওয়ে ব্যবহার ফি ৪০ লাখ টাকা প্রদান সাপেক্ষে জেলা পরিষদ ঘাটটি পরিচালনা করবে। তবে তিন বছর পর আলোচনা সাপেক্ষে উভয়পক্ষ বার্ষিক এই ফি বাড়াতে বা কমাতে পারবে। সর্বশেষ তিন বছরে জেলা পরিষদ বিআইডাব্লিউটিএ’কে বার্ষিক ৫৫ লাখ টাকা প্রদান করে আসছিল।

কিন্তু নদী বন্দর ঘোষণা, চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এবং ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগ ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সকল ঘাট/পয়েন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও ইজারা প্রদানে ক্ষমতা দেয়ায় সমঝোতা স্মারক নবায়ন করতে অনাগ্রহী বিআইডাব্লিউটিএ। এ জন্য ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জেলা পরিষদের সাথে সমঝোতা স্মারক নবায়ন না করতে অনুরোধ জানায় বিআইডাব্লিউটিএ’র চট্টগ্রাম কার্যালয়।

বিআইডাব্লিউটিএর পরিচালককে (বন্দর ও পরিবহন বিভাগ) দেয়া এক পত্রে দ্রুত সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি বাতিল ও নতুন করে ঘাটটি ইজারা প্রদান করতে চায় বিআইডাব্লিউটিএ। অন্যদিকে জেলা পরিষদ চাচ্ছে, ফের আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে ঘাটটির মালিকানা নিজেদের কাছে রাখতে। এ জন্য ঢাকায় তদবির করছেন এ সংস্থার উর্ধ্বতনরা। জটিলতা নিরসন করতে ১ মার্চ আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকা হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ঘাট/পয়েন্টের ইজারা, উন্নয়ন ও পরিচালনার বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান সমূহ ও বিআইডাব্লিউটিএর সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি মন্ত্রী পর্যায়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে। ওই সভায় নৌপথের সকল ঘাট/পয়েন্টের উন্নয়ন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা বিআইডাব্লিউটিএ’র নিয়ন্ত্রণে রেখে বিরোধপূর্ণ ঘাট/পয়েন্টের ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি অংশ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত দেশের বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার বিভাগের সংস্থা প্রতিপালন না করায় ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় নৌপথের সকল ঘাট/পয়েন্টের উন্নয়ন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা বিআইডব্লিউটিএর নিয়ন্ত্রণে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে আলোচনার মাধ্যমে বিরোধপূর্ণ ঘাট/পয়েন্টের ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি অংশ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

তবে ওই সভার সিদ্ধান্তও মানতে রাজী হচ্ছে না চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ। ফলে বিরোধপূর্ণ এই ঘাটের ইজারা এবং ২০১৪ সালের ন্যায় নৌ যান চলাচলে অচলাবস্থা তৈরির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিআইডাব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, সন্দ্বীপের প্রধানতম নৌ রুট হওয়ায় এই ঘাটের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব বাবদ আয় ছাড়াও বিভিন্নভাবে আয়ের সুযোগ থাকায় জেলা পরিষদ এই ঘাটটি থেকে নিজেদের কর্তৃত্ব ছাড়তে রাজি নয়। এ কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ইজারা মূল্য প্রদানের কারণে ইজারাদার প্রতিষ্ঠান যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে অস্বাভাবিক ভাড়া আদায় করছে।

এদিকে মালিকানা পাওয়ার আশায় বিআইডাব্লিউটিএ ইতোমধ্যে নৌ পথে ৪টি বয়া স্থাপন করেছে। উভয় পাশের জেটিতে লাইটিং ছাড়াও, যাত্রীদের বসার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা। ওঠা-নামার কষ্ট দূর করতে নিয়মিত ড্রেজিংও করতে চায় তারা। আবার যাত্রী ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা (স্পিডবোট) থেকে কমিয়ে ২০০ টাকা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিআইডাব্লিউটিএ।

এআরটি/কেএস/এমএহক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!