দোকানের সামনে সাইনবোর্ডে লেখা ‘এখানে দাঁড়ানো নিষেধ।’ কিন্তু কে দেখে কার বারণ? কারণ প্রিয়জন যে রয়েছে কারাবন্দি। প্রিয়জনকে এক পলক দেখতে সেখানে ভিড় করেন কারাবন্দীদের স্বজনরা। কারাগারের জানালায় দাঁড়িয়ে সুখ-দুঃখের কথা জানাতে না পারলেও স্বজনের সঙ্গে ইশারা ইঙ্গিতে, আবার কখনো চিৎকার করে সাড়েন জরুরি আলাপ। এমনকি এক কারাবন্দির প্রিয়জনকে চিরকুট পাঠাচ্ছে অন্য কারাবন্দি।
প্রতিদিন এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে চট্টগ্রাম নগরীর আমানত শাহ (রহ.) মাজার শরীফ সংলগ্ন জেল রোডে।
কারাবন্দীদের স্বজনের উৎপাতে প্রতিদিন বিরক্ত হন আশপাশের ব্যবসায়ীরা। সকাল-বিকাল তাদের জটলায় ক্রেতা প্রবেশ করতে পারে না দোকানে। দোকানের সামনে লাগানো সাইনবোর্ডও ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলেও অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিষ্ঠান খোলার সময় থেকে শুরু করে সন্ধ্যা নামা পর্যন্ত মানুষের ভিড় লেগে থাকে। সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচিতো আছেই। ফোনে কথা বলতে গেলেও অনেকজনকে আস্তে কথা বলার জন্য বারণ করতে হয়। দোকানের সামনে জটলা থাকার কারণে খুচরা ক্রেতারা প্রবেশ করতে পারে না। এতে আমাদের কাস্টমার অন্য জায়গায় গিয়ে কেনাকাটা করছেন।
‘আজকে তোর জামিন হয়নি। আগামী বৃহস্পতিবারে জামিন হতে পারে। যদি না হয় হাইকোর্টে জামিনের জন্য দরখাস্ত করবেন উকিল’—দোকানের সামনে থেকেই চিৎকার করে ছেলের উদ্দেশ্যে এসব বলছিলেন নাসিমা আকতার।
ওপারে কারাগারের জানালায় দাঁড়িয়ে ছেলে জানান, আজ কেন জামিন হয়নি? উকিলতো বলেছিলেন আমি জামিন পেয়ে যাব। উনার সঙ্গে আমার গত সপ্তাহে কথা হয়েছিল। তখন তিনি বলেন, এ সপ্তাহে জামিন নিয়ে দেবেন।
তাদের আলাপচারিতার মাঝে কানে ভেসে এলো মোস্তবা খাতুনের ক্ষিপ্ত কণ্ঠ। তিনি বলেন, ‘যে বড় ভাইয়ের জন্য এখানে (কারাগার) ঢুকলি সে তোর কোনো খোঁজ নিছে? মামলা চালাইতে অনেক টাকা প্রয়োজন, তা তো আমার কাছে নাই। তোর সাজাও হয়ে যেতে পারে। আমি কি করবো?’
সেই ছেলে জেলের জানালায় দাঁড়িয়ে মায়ের বকা খেয়ে তাকিয়ে রয়েছে। তার পাশ থেকে অন্য এক কারাবন্দি একটি কাঠিতে রাবার পেঁচিয়ে গুলতির মত বানিয়ে রাস্তায় ছুঁড়েন। এ সময় এক তরুণী সেটি নেয়। তরুণীর দিকে লক্ষ্য করতেই দেখা যায় ওই চিরকুটে লেখা, ‘আমার আম্মুকে এখানে আসতে বলবেন’। নিচে একটি ফোন নম্বরও জুড়ে দেওয়া হয়। তরুণীকে সেই নম্বরে ফোন কলে কথা বলতে দেখা যায়।
চিরকুট পাঠানো কয়দি তরুণীর কি হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারাগারে আমার ভাইয়ের সঙ্গে একই ওয়ার্ডে থাকেন। উনার মাকে ফোন দিয়ে কারাগারে আসার জন্য বলতে বলেছেন। তাই ফোন করে বলে দিলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়ালে আরো অনেক চিরকুট আসতে দেখবেন। আমার মত অনেকেই তাদের এভাবে সহযোগিতা করছে। অনেক পথচারীও তাদের এসব চিরকুট পেয়ে পরিবার বা প্রয়োজনীয় ফোন নম্বরে কল করে সহযোগিতা করেন।’
এরপর কারাগার থেকে আরও অনেক চিরকুট আসতে দেখা গেছে। একটিতে লেখা, ‘মিজান আজকে বের হতে পারবে কি না?’ নিচে রয়েছে দুটি ফোন নম্বর। অন্য এক চিরকুটে ফোন নম্বরের নিচে লেখা, ‘এই জায়গায় আসতে বলেন-বেলাল।’ এমন আরো কত চিরকুট পড়ে আছে জেল রোডে।
এসময় দুইজন যুবককে কারাগারের নির্মাণাধীন সীমানা প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন কয়েদির সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। তাদের বেশ কিছু নম্বরে ফোন কল করতেও দেখা যায়।
তাদের বিষয়ে এক কয়েদির স্বজন অভিযোগ করে বলেন, ‘ফোন কলে তথ্য দেওয়ার বিনিময়ে কয়েদির স্বজনদের কাছ থেকে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয় এমন কিছু চক্র।’
কারাগারে সরাসরি না গিয়ে কেন রাস্তায় ভীড় করছেন, জানতে চাইলে মো. রোবেল নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘কারাগারেতো মাসে একবারের বেশি দেখা করা যায় না। কিন্তু এখানে যখন তখন দেখা যায়। চিৎকার করে হলেও কথা বলা যায়।’
সিনিয়র জেল সুপার মো. গিয়াস উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কারাবন্দির স্বজনরা মাসে দু’বার দেখা করতে যেতে পারেন। অর্থাৎ ১৫ দিন পর পর দেখা করা যায়। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে একবার ফোন কলে কথা বলার সুযোগ রয়েছে।’