কাপাসগোলায় যৌন হয়রানি, সেই ছাত্রী ঘরবন্দি, তদন্ত নিয়ে শঙ্কা

৬ বছর আগে— ২০১৩ সালে দ্বাদশ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করে বরখাস্ত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম নগরীর কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন। সমস্ত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু বিভাগীয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিমের সাথে কথা না বলেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ৫ বছর পর একই বিদ্যালয়ে ফের প্রধান শিক্ষক ফিরে এসে তিনি হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া।

অভিযুক্ত ওই প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আবার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠার পর তোলপাড় সৃষ্টি হলে গত ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সিটি সিটি করপোরেশন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। চসিকের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিনকে প্রধান করে জরিনা মফজল সিটি করপোরেশন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাজেরা খাতুন এবং দেওয়ানহাট সিটি করপোরেশন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ঝিনু আরা বেগমকে নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিকে সাত কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা হয়। তবে তদন্ত কমিটি ‘তদন্তের স্বার্থে’ আরও সময় বাড়িয়ে নিয়েছে বলে জানা গেছে সোমবার (৬ জানুয়ারি)।

তদন্ত কমিটির তৎপরতা সত্ত্বেও কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তদন্তের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইতিমধ্যে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ২০১৩ সালের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কিনা— এ নিয়ে অনেক অভিভাবকই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, তদন্ত প্রতিবেদন প্রধান শিক্ষকের পক্ষে নিতে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা তৎপর। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া অভিযুক্ত ওই প্রধান শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী, তিনিও তদন্তে প্রভাব বিস্তার করছেন— এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন অভিভাবক। তারা বলছেন, এবারও যদি ওই প্রধান শিক্ষক পার পেয়ে যান, তাহলে ছাত্রীদের স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।

জানা গেছে, তদন্ত কমিটির তিন সদস্য গত ৫ জানুয়ারি কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের বক্তব্য নেন। ওইদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত স্কুলে অবস্থান করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

৫ জানুয়ারি, সকাল ১০টা
গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও সিটি করপোরেশনের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন শুরুতেই শিক্ষকদের সামনে ব্রিফিং দেন। তিনি সকলের উদ্দেশ্য বলেন, ‘উনি (অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মো আলাউদ্দিন) একজন সম্মানিত ব্যক্তি। উনার সম্মানে যাতে আঘাত না হয় এভাবে বলবেন। যারা যারা স্বেচ্ছায় পক্ষে-বিপক্ষে বলতে চান তারা নাম জমা দিতে পারেন।’

এ কথা বলার পর শিক্ষকরা চুপ করে ছিলেন। একজনও ঘটনা প্রসঙ্গে বক্তব্য দেওয়ার জন্য নাম জমা দেননি। কেবল একে অন্যকে খালি কাগজ এগিয়ে দেন। যৌন হয়রানির মতো স্পর্শকাতর ও গোপনীয় বিষয়ে এভাবে প্রকাশ্যে অভিযোগ জমা দিতে বলায় বিস্ময়ে সবাই নিঃশব্দে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন। এভাবে দুই ঘন্টা পার হয়ে যায়।

সময় দুপুর ১২টা
পক্ষে-বিপক্ষে বলার জন্য কেউ নাম জমা না দিলে পরবর্তীতে দুপুর ১২টার পর জাহানারা বেগম নামের শিক্ষককে দিয়ে একজন একজন করে বক্তব্য নেওয়া শুরু হয়। তার বক্তব্যের জেরে ঘটনার প্রসঙ্গে একে একে বাকিদেরও বক্তব্য নেওয়া হয়। সকলের বক্তব্য নেওয়া হলে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’র চার সদস্যকে একত্রে ডাকা হয়। সেখানে কথা বলার একপর্যায়ে তদন্ত কমিটির তিন সদস্য একই সুরে তাদেরকে ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা বোঝানোর চেষ্টা করেন। তারা বলেন, ‘এখানে আসলে এমন কিছু হয় নাই। আয়া-বুয়ারাই মুখে মুখে ঘটনাটা ছড়িয়েছে। আর পত্রিকা অফিস পেয়ে রঙ ছড়িয়ে লম্বা করছে। এতে স্কুলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।’

তদন্তে যাদের বক্তব্য নেওয়া হয়
শিক্ষিকা জাহানারা বেগম, উম্মে সালমা, মমতাজ উদ্দিন, মারুফা, মাইনুদ্দিন, মনিরুল ইসলাম, মোরশেদ হাসান, সিরাজুল ইসলাম, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির চার সদস্য শুক্লা দাশ, বোধিমিত্র শর্মা, মানস কান্তি সেন ও ফারহানা হক। এছাড়া রয়েছেন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সিরাজুল ইসলাম, হাজী সেলিম রহমান ও অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক বলেন, ‘আমরা সকলে উনার অধীনে কাজ করি। ঘটনা সবাই জানলেও স্বভাবতই শুরু থেকেই এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চায়নি। আড়ালে যাও কয়েকজন বলেছে, কিন্তু তদন্ত কমিটির এমন প্রক্রিয়া দেখে অবাক হচ্ছি। সেখানে সবার সামনে প্রধান শিক্ষকের গুণগান গাওয়ায় তদন্ত কোন দিকে গড়াচ্ছে তা বোঝাই যাচ্ছে।’

আরেকজন শিক্ষক বলেন, ‘উনি আবারও বহাল তবিয়তে এখানে থাকবেন। এখন আমরা উনার অধীনস্থ। তাহলে বুঝতেই পারছেন বিষয়টা। তাছাড়া উনি এতো এতো লবিং মেইনটেইন করে চলেন যে, কেউ উনার অপকর্ম নিয়ে বলতে চায় না।’

অপর একজন শিক্ষক বলেন, ‘ তদন্ত প্রক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে কমিটির সদস্যরা চাপে আছেন। নয়তো ঘটনার সত্যতা থাকার পরেও উল্টো অভিযুক্তের সাফাই গাওয়া হচ্ছে কেন।’

জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সদস্যরা স্কুলে অবস্থানকালে স্থানীয় কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু হঠাৎ নালা-নর্দমা পরিদর্শনে যান। তিনি তদন্ত কমিটির আশেপাশেই ছিলেন বলে জানিয়েছেন একজন অভিভাবক। অন্যদিকে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সিরাজুল ইসলাম সারাদিন অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষককে সঙ্গ দিয়েছেন।

এদিকে নানামুখী চাপে রীতিমতো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগী ছাত্রীর পরিবার। যদিও এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী ছাত্রীর পরিবার অস্বীকার করেন।

তবে ঘটনা প্রসঙ্গে ছাত্রীর অভিভাবক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভাই আমি কারও রোষের মুখে পড়তে চাই না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কী করতে পারতাম বলেন। হয়তো ওই সময় যদি জানতাম ও (প্রধান শিক্ষক) জাহান্নামে যাক আমি আমার মেয়েটাকে সরাই ফেলতাম। অন্ততপক্ষে মানুষের কথা থেকে বাঁচতে পারতাম। এখন কিছু বলতে পারছি না। কারণ আমার গায়ে থুথুর দাগ লাইগা গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি একা মানুষ। আমার দুকূলে কেউ নাই। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আমি কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আমার কোনো অভিযোগ নাই। আমি একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি মেয়েকে একেবারে গোপালগঞ্জে পাঠায় দিবো। কিন্তু সবাই বলছে এই মূহুর্তে না পাঠাতে। এটা মীমাংসা হোক তারপর…।’

এদিকে, ভুক্তভোগী ছাত্রী নতুন ক্লাসে ভর্তি হলেও নিয়মিত স্কুলে যেতে পারছে না। অনেকটা ঘরবন্দি জীবনযাপন করছে।

তদন্ত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। তবে তারা আরও দু একদিন সময় চেয়ে আবেদন করেছেন। প্রতিবেদন এলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শিক্ষা কর্মকর্তার বন্ধু বলে নাম ভাঙিয়ে প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছেন— এমন প্রশ্নে সুমন বড়ুয়া গত ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা সত্যি তিনি আমার সহপাঠী। আর ক্লাসমেট, বন্ধু মানে তার অপরাধের সঙ্গী না। বন্ধু বলে তো পার পেয়ে যাবে, তা তো হতে পারে না। এখন আমি তার পক্ষে কাজ করছি কিনা সেটাই দেখার বিষয়। এটাকে পার পাওয়া কিংবা ধামাচাপা দেয়ার কোনো সুযোগ নাই। এখন যদি তদন্ত কমিটি করার পর কমিটি রিপোর্ট না দেয় তাহলে আমি কী করবো। তবে ছোটখাটো শাস্তি তো আমি দিতে পারবো। আমি এই সমস্ত বিষয়কে ছাড় দেই না।’

এদিকে তদন্ত কমিটির প্রধান চসিকের আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!