কাজ শেষের আগেই ধসে পড়ল কর্ণফুলীর কালারপোল সেতু, ৩ শ্রমিকের খোঁজ মিলছে না

৩৫ টন ওজনের তিন গার্ডার মুহূর্তেই তলিয়ে গেল নদীতে

মেয়াদ বেড়েছে তিন দফা। তবু শেষ হয়নি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা-পটিয়ার (আংশিক) কালারপোল সেতুর নির্মাণকাজ। শেষপর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই শুক্রবার (২৫ জুন) রাত ৮টার দিকে নির্মাণাধীন সেতুটির তিনটি গার্ডার ধসে পড়ল। এ সময় নির্মাণকাজে নিয়োজিত তিনজন শ্রমিক নিখোঁজ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অন্তত দুজন আহত শ্রমিককে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

এলাকাবাসী সেতুটি ধসে পড়ার পেছনে ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, একটি সেতুর জন্য ১৩ বছর ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কর্ণফুলী-পটিয়ার কয়েক লাখ মানুষের। তবে অন্যদিকে সওজের দাবি, কোনো অনিয়ম হয়নি সেতুর নির্মাণকাজে।

দোহাজারী সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ জানান, ‘হাইড্রোলিক জ্যাকের (ক্রেন) মাধ্যমে গার্ডার বসানোর সময় জ্যাকের পাইপ ফেটে যাওয়ায় সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, যার ফলে গার্ডার পড়ে যায়। তিনি বলেন, একটি গার্ডার থেকে আরেকটি গার্ডারের দূরত্ব দুই মিটার। যে কারণে একটির ধাক্কায় আরেকটি এভাবে তিনটি গার্ডার পড়ে যায়। কাজেই কোনো অনিয়ম হয়নি। এতে ঠিকাদারের ৭৫ লাখ টাকার ক্ষতি হবে বলে তিনি দাবি করেন।’

কাজ শেষের আগেই ধসে পড়ল কর্ণফুলীর কালারপোল সেতু, ৩ শ্রমিকের খোঁজ মিলছে না 1

তিনি আরও জানান, ‘এটি আসলে দুর্ঘটনা। সেতুটির প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে একটি দুর্ঘটনায় সেতুটি ধসে পড়েছে। তিনি বলেন, কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি। এটি নিছক দুর্ঘটনা। একটি গার্ডারের ওজন ৩৫ টন।’

কালারপোল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মুহাম্মদ সোলায়মান জানিয়েছেন, ‘সেতু ধসের ঘটনায় কয়জন নিখোঁজ রয়েছে তা এ মুহুর্তে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে দুজন আহত শ্রমিককে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’

সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুটির তিনটি গার্ডার ধসে নদীর পানির সঙ্গে মিশে গেছে। ঘটনাস্থলে কথা হয় স্থানীয় কোলাগাঁও ইউনিয়নের কালারপোল এলাকার বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন ও শিকলবাহা ইউনিয়নের মাষ্টারহাটের বাসিন্দা আলমগীরের সঙ্গে।

তারা জানান, রাত ৮ টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। পরে আমরা গিয়ে দেখতে পায় গার্ডার ভেঙ্গে নদীর তলদেশে মিশে যায়। ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজের কারণে সেতুটি ধসে পড়েছে। এতে সেতু নির্মাণকাজে নিয়োজিত তিনজন শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছে। তারা আক্ষেপ করে জানান, একটি সেতুর জন্য ১৩ বছর ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কয়েক লাখ মানুষকে। তিন দফা মেয়াদ বাড়ানোর পরও পটিয়ার কালারপোল সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই ধসে পড়ার ঘটনা খুবই মর্মান্তিক।

দোহাজারী সওজ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ১৮ নভেম্বর সেতুটি ভেঙে যাওয়ার পর নতুনভাবে সেতু নির্মাণের জন্য প্রথমবার ২২ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় সেতু মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কিছুদিন কাজ করে। একসময় কাজ চলাকালীন কাজ বন্ধ করে চলে যায়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় মেয়াদে সেতুর জন্য ২০১৭ সালে এটি ২৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা নতুনভাবে বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর নামে সেতুটির নামকরণ হয়। এটির নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কালারপোল সেতু ১৯৯৫ সালে নির্মিত হয়। ২০০৭ সালের ১৮ নভেম্বর একটি কারখানার টিনের কয়েল বোঝাই বাজের আঘাতে সেতুর তৃতীয় ও চতুর্থ স্প্যান নদীতে নিমজ্জিত হয়। সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন হওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুরোনো স্প্যানটির ওপর সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য একটি বেইলি ব্রিজ তৈরি করে দেয়। দ্বিতীয় দফায়ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বছর দুয়েক সেতুর কাজ করার পর লোকসান দেখিয়ে কাজ ফেলে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সেতু মন্ত্রণালয়। দেড় বছর আগে নতুনভাবে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘসময় ধরে ধীরগতিতে চলছে কালারপুল সেতুর নির্মাণকাজ। এখন পর্যন্ত পাঁচটি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, খাল পারাপারে সেতুটি একমাত্র ভরসা হওয়ায় ওই পথে যাতায়াতে ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। কালারপোল লাখেরা উচ্চ বিদ্যালয়, কালারপোল হাজি ওমরা মিয়া চৌধুরী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, কালারপোল অহিদিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, এ জে চৌধুরী স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া করে। এ ছাড়া সেতুর উভয় পাশে গড়ে ওঠেছে কয়েকটি শিল্প-কারখানা, লবণ কারখানা, শতাধিক পোলট্রি ও ডেইরি ফার্ম। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের খাল পারাপারে কষ্টের সীমা নেই।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!