কাজ বন্ধ, আয় শূন্য— তবু বেতন-বোনাস চলবে তিন পোশাক কারখানায়

করোনার অজুহাতে শ্রমিক ঠকানো, বেতন নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা, পথে পথে বিক্ষোভ-আন্দোলনের উল্টো পিঠে আছে অন্য দৃশ্যও। সেই দৃশ্য স্বস্তির— একই সঙ্গে ভালোবাসারও। কারখানা খোলা হোক বা না হোক, আয় আসুক বা না আসুক— বেতন-বোনাস না পেয়ে থাকবে না কোনো শ্রমিক। এমনকি দুর্যোগেও সামনের মাসগুলোতে বাকি থাকবে না কোনো শ্রমিকের বেতন— আশ্বাসের বাণীটি এসেছে এভাবেই। আশ্বাসেই আটকে না থেকে রূপ পেয়েছে বাস্তবেও। করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগেও দেশের তিনটি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান এপ্রিল মাসের বেতন তো বটেই, সঙ্গে শ্রমিকদের হাতে তুলে দিচ্ছে ঈদ বোনাসও। অথচ কারখানাগুলো বন্ধ সেই ২৫ মার্চ থেকে। আয় নেই এক টাকাও।

সারা দেশে এমন উদ্দীপনা জাগানো উদাহরণ তৈরি করা তিন প্রতিষ্ঠানের একটি চট্টগ্রামের— ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড। অপর দুটি প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জভিত্তিক। এগুলো হল এসপি গ্রুপ ও ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেড। করোনাকাণ্ডে পোশাকশিল্পে চলমান দুর্যোগের মধ্যেও এই তিন প্রতিষ্ঠানই ঘোষণা দিয়েছে একজন শ্রমিককেও ছাঁটাই না করা হবে না।

বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে চট্টগ্রামের রাজপথেই কয়েক দফায় দেখা গেল পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ। এপ্রিল মাসের শেষেও অনেক গার্মেন্টসের শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতনের দাবিতে আন্দোলন করতে দেখা গেছে। পোশাকশিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান বেতনের ভার বইতে না পেরে পুরো প্রতিষ্ঠানই লে-অফ ঘোষণার পথে হেঁটেছেন। পোশাকখাতের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই মালিকদের অজুহাতও এখন একটিই— করোনাভাইরাসের মন্দা। অথচ এমন অবস্থায়ও নিজেদের কর্মীদের ভোলেনি ওই তিনটি বড় পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রামভিত্তিক পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড
চট্টগ্রামভিত্তিক পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড

চট্টগ্রামভিত্তিক পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের কর্মীসংখ্যা ২ হাজার। কর্ণফুলী ইপিজেডে প্রতিষ্ঠানটির বড় কারখানা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পণ্য পাঠিয়ে বছরে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে ডেনিম এক্সপার্ট। তবে করোনার বিশ্বব্যাপী দুর্যোগে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১ কোটি মার্কিন ডলার অর্থমূল্যের অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। ভবিষ্যতের অর্ডারগুলোও হয়ে গেছে স্থগিত। প্রতিষ্ঠানটির আনুষঙ্গিক খরচ ও ব্যাংক ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে পড়ে অনেক কারখানা যেখানে শ্রমিক ছাঁটাই করছে, কোনো কোনো কারখানা যেখানে শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতনই দেয়নি— সেখানে শ্রমিক ছাঁটাই না করে কিংবা বেতন নিয়ে গড়িমসি না করে উল্টো বেতন পরিশোধের এই বিরল সৌজন্যতার রহস্য কী?

ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘শ্রমিকরা আমার পরিবারের সদস্যের মতোই। আমি আমার কর্মীদের বড় কোনো বিপদের মুখে ফেলে দেওয়ার কথা কোনোদিনই ভাবিনি। তাই এই দুর্যোগে আমরা আমাদের কর্মীদের সত্যিকারের খেয়াল রাখছি।’

ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড ইতিমধ্যে জানিয়েছে, কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের এপ্রিল মাসের পুরো বেতন এবং ঈদ বোনাস পরিশোধ করা হবে যথাসময়ে।

ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশের ক্রেতা ‘ইনডেক্স’। ওই ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মোস্তাফিজ উদ্দিন জানান, ‘ইনডেক্স কোনো অর্ডার বাতিল করেনি কিংবা কোনো পেমেন্টও স্থগিত রাখেনি।’

নারায়ণগঞ্জের এসপি গ্রুপের কারখানায় কাজ করেন ৩ হাজার ৩০০ শ্রমিক। তাদের প্রতি মাসের বেতন প্রায় ৫ কোটি টাকা। এসপি গ্রুপের দুটি বড় ক্লায়েন্ট— বেলজিয়ামের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘বিএলসি’ এবং সুইডিশ ‘কটন গ্রুপ’। এর মধ্যে বিএলসির সঙ্গে ২৬ বছর ধরে ব্যবসা করছে বাংলাদেশের এসপি গ্রুপ। ওই প্রতিষ্ঠান কোনো অর্ডার কিংবা শিপমেন্ট বাতিল করেনি। বর্তমানে চট্টগ্রাম ও ইউরোপের বন্দরগুলোতে এসপি গ্রুপের প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের প্রোডাকশন আটকা পড়ে রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুবল চন্দ্র সাহা বলেছেন, ‘কারখানা আবারও চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত, তিনি নিজে এক টাকাও উপার্জন করতে না পারলেও, তার শ্রমিকরা পুরো বেতন পাবেন।’

তিনি বলেন, ‘এসপি গ্রুপ তার সব শ্রমিকের মার্চ মাসের পুরো বেতন ইতোমধ্যেই দিয়েছে। শ্রমিকরা যেন ঈদের উৎসব আনন্দ নিয়ে উপযাপন করতে পারেন, এখন সে লক্ষ্যে তাদের ঈদ বোনাস প্রস্তুতের কাজ করছে মানবসম্পদ বিভাগ।’

সুবল চন্দ্র সাহা জানান, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে তারা সবার আগে বিবেচনা করেন। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি মেনে ২৫ মার্চ উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটি। আবার এর এক মাস পরও বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এর বিস্তার ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, এই বিবেচনায় উৎপাদন পুনরায় শুরু করেননি তিনি।

এসপি গ্রুপের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানালেন, ‘পোশাকশ্রমিকরা অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ছোট ছোট রুমে জীবনযাপন করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একই টয়লেট তাদের অনেককে ব্যবহার করতে হয়। গার্মেন্ট সংলগ্ন এলাকাগুলোতেই শ্রমিকরা বসবাস করেন, সেখানে ভাইরাসটি ব্যাপক মাত্রায় ছড়ানোর আশংকা থেকেই যায়।’

সুবল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে আমরা পহেলা জুন থেকে কার্যক্রম আবার শুরু করার পরিকল্পনা করছি। অন্যথায় পহেলা জুলাই শুরু করব।’

নারায়ণগঞ্জভিত্তিক ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেডের কর্মীসংখ্যা ১ হাজার ১০০ জন। ইউরোপে পোশাক রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটির আয় বছরে ১ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অবিচ্ছেদ্য ব্যবসায়িক সম্পর্ক ইউরোপের দুই ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ‘হ্যাপি চিক’ ও ‘ফোপেম’-এর সঙ্গে।

নিট কম্পোজিটরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে শামীম এহসান জানান, ‘বৈশ্বিক এই মহামারির কারণে উৎপাদন যথেষ্ট বিঘ্নিত হলেও তাদের কোনো বায়ারই অর্ডার বাতিল করেনি। এই বায়ারেরা এখনো আমার কারখানায় ছোট ছোট অর্ডার দিচ্ছে।’

উৎস: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!