কাউন্সিলর লালুর ইশারা ছাড়া ভূমি অফিসের ফাইল নড়ে না

কক্সবাজারে ৬০ দালালের চক্র

কক্সবাজারের পৌর কাউন্সিলর লালু সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের চেক পাওয়া ছিল রীতিমতো অসম্ভব একটি কাজ। কক্সবাজার পৌরসভা এলাকায় হলেও ঝিলংজা মৌজা থেকে রেললাইনে অধিগ্রহণ হওয়া ৮০ ভাগ জমির ফাইল জমা থেকে শুরু করে চেক নিতেন কক্সবাজার পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের এই বিতর্কিত কাউন্সিলর ওমর ছিদ্দিক লালু।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তালিকাভুক্ত ৬০ দালালের চক্রে এই জনপ্রতিনিধির নাম আছে। লালুর সম্পদের হিসাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুদক ইতিমধ্যে বেশকিছু চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে।

কক্সবাজার পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার আগে ওমর ছিদ্দিক লালু সার বীজের একটি দোকান চালাতেন। সেই লোকটিই মাত্র কয়েক বছরের মাথায় এখন কোটি কোটি টাকার মালিক— স্থানীয়ভাবে এমন কথা এখন মুখে মুখে।

জানা গেছে, শুরু থেকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজসে এলাকার সমস্ত ভূমি অধিগ্রহণে ছিল এই কাউন্সিলর লালুর হাত। এমনও দেখা গেছে, যারা তার কাছে ফাইল জমা দেননি, তাদের অনেকে ৪-৫ বছর পেরিয়ে গেলেও পায়নি ক্ষতিপূরণের প্রাপ্য টাকা।

শুধু ক্ষতিপূরণের প্রাপ্য টাকা নিয়েই নয়ছয় নয়, কাউন্সিলর লালু নানান ছলে, কখনও আবার হুমকিধমকি দিয়ে নিজের স্ত্রী, স্ত্রীর বোন ও নিকটাত্মীয়দের নামে ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ নিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অংকের টাকা।

কক্সবাজার পৌর এলাকার উত্তর ডিককুল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল করিম, সিরাজুল ইসলাম, মোস্তাক, নুরুল হকসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন থেকে ২-৩ বছর আগে যখন পৌরসভার কিছু অংশ এবং ঝিলংজা মৌজায় ৭ ধারার নোটিশ দেওয়া শুরু হয়, তখন থেকে স্থানীয় কাউন্সিলর ওমর ছিদ্দিক লালুর নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এই সিন্ডিকেটই সেখানে ৮০ ভাগ জমির ফাইল প্রসেসিং থেকে শুরু করে সর্বশেষ ধাপে ক্ষতিপূরণের চেকটিও গ্রহণ করেছে নিজেরাই।

তারা বলেন, ‘আমাদের নিজেদের জমির কাজও তারা করেছে। বিনিময়ে ২৫% থেকে ৩০% কমিশন আদায় করেছে।’

তাদের দাবি, কাউন্সিলরের সাথে বর্তমানে খুরুশকুল এলাকার রুবেল, লিংক রোডের সার ব্যবসায়ী মহেশখালীর আমিন, বিজিবি ক্যাম্প এলাকার আবু সাঈদ ও তার চাচা জহির সওদাগর, কাউন্সিলর লালুর স্ত্রী সেলিনা আক্তার, স্ত্রীর বোন রুবি আক্তারের ব্যাংক হিসাব তল্লাশি করলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।

এলাকার অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, প্রথমদিকে অনেকে ৭ ধারার নোটিশ পাওয়ার পরে এলএ অফিসে গিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সে সময় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরাসরি স্থানীয় কাউন্সিলর লালুকে দেখিয়ে দিতেন। তার সম্মতি ছাড়া কোনো ফাইল ওই কর্মকর্তারা জমা নিতেন না। আবার কেউ জোরাজুরি করলে তাদের নানান আইনি জটিলতায় ফেলে দিত। পরে কাউন্সিলর লালুর কাছে আসলে তারা অল্প টাকার বিনিময়ে তাদের সিন্ডিকেটের কারও নামে ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ নিয়ে এলএ অফিস থেকে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিতো।

জানা গেছে, এলাকার মাস্টার আবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি লালু সিন্ডিকেটের অত্যাচারে নিজের জমির টাকা তুলতে না পেরে স্ট্রোক করে মারা গেছেন।

অধিগ্রহণ করা অনেক ভূমির ওয়ারিশ আছে ১০-১৫ জন। লালু সিন্ডিকেট এদের মধ্যে কয়েকজনকে হাত বাকিদের জায়গায় ভুয়া লোক দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতেন— এমন অভিযোগ অনেক আছে। তার এসব অপকর্মের মূল খুঁটি হচ্ছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার শীর্ষ কর্মকর্তারা। এভাবেই লালু কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন মাত্র কয়েক বছরেই।

কাউন্সিলর হওয়ার আগে রিকশাই যার সম্বল ছিল, সেই লালু এখন চলাফেরা করে ৩০ লাখ টাকা মূল্যের টিআরএস গাড়িতে। মহেশখালীর ইউনুসখালী এবং ঝাপুয়া মৌজাতে কিনেছেন ৫০ কানি জমি। কিছুদিন আগে উত্তর ডিককুল এলাকায় কিনেছেন কোটি টাকা মূল্যের ১৬ শতক জমি। এছাড়া হাজীপাড়ায় ৬ শতক এবং এসএম পাড়ায় দেড় কানি জমি কিনেছেন কক্সবাজার পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের এই বিতর্কিত কাউন্সিলর। তবে এগুলোই শুধু নয়, তার সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের নামেও তিনি আরও অনেক জমি কিনেছেন— এমন দাবি করেছেন স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র।

কাউন্সিলর লালুর বিরুদ্ধে কক্সবাজারের লিংকরোড ও কলাতলীসহ বিভিন্ন জায়গায় চলাচলকারী যানবাহন থেকে নিজস্ব বাহিনী দিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগও দীর্ঘদিনের।

অভিযোগ প্রসঙ্গে কাউন্সিলর ওমর ছিদ্দিক লালু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি কোনো জমি কিনিনি। চাঁদাবাজির কোনো ঘটনার সঙ্গেও জড়িত নই। আমি এলএ শাখার কাজ করেছি আমার নিজের ও শ্বশুরের কাজ। এছাড়া আর কারও কাজ করিনি। যেসব জমি আমি কিনেছি বলা হচ্ছে তাও সঠিক না। কিছু জমি আছে তা আমার পৈত্রিক সম্পত্তি।’

বিতর্কিত এই কাউন্সিলর বলেন, ‘যেহেতু আমি জনপ্রতিনিধি। অনেকে শত্রুতা করে আমার নামে বদনাম ছড়াচ্ছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!