জয়নাল আবেদীন, রাউজান (চট্টগ্রাম) :
“কি গান মাঝি হুনাইলা. কি বাঁশি মাঝি বাজাইলা, ‘কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালা আঁর মন হরি নিলা”/ “ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা” এক সময় চট্টগ্রামে এই ধরণের অসংখ্য জনপ্রিয় আঞ্চলিক গান রচিত হয়েছিল কর্ণফু
লি নদী ও কর্ণফুলির সাম্পানওয়ালাকে নিয়ে।
কর্ণফুলি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী। এই নদী পার্বত্য রাঙ্গামাটির লুসাই পাহাড় থেকে সৃষ্টি হয়ে চট্টগ্রামের বুক চিরে পাহাড়-সমতল মাড়িয়ে নিজেকে সমর্পণ করেছে বঙ্গোপসাগরে। এই নদী শান্ত নয় আবার উন্মাতালও নয়। মাঝারি মেজাজের এই নদীকে ঘিরেই হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন, ভালোবাসা, বেঁচে থাকা।
কর্ণফুলি নদীর জোয়ার-ভাটার সাথে সাম্পান নিয়ে মিতালী গড়ে তোলা তাদেরই একজন কর্ণফুলির সাম্পান ওয়ালা কবির আহম্মদ মাঝি (৬০)। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে যৌবনে ঊষালগ্নে দারিদ্রে নিমজ্জিত পিতার অভাবী সংসারের হাল ধরতে ধরেন সাম্পানের বৈঠা। সেই থেকে কর্ণফুলীর সাথে মিতালী।
সম্প্রতি রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নস্থ ঐতিহ্যবাহী সুপ্রচীন লাম্বুর হাটের নৌকা ঘাটে যাত্রীর জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় আলাপ হয় এই সাম্পানওয়ালা কবির মাঝির সাথে। তিনি বলেন, জীবনের বেশীর ভাগ সময় এই সাম্পান নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি, বাকি সময়টুকু এটি নিয়ে কাটিয়ে দিতে চাই। কিন্তু আগের মত লোকজন নদী পথে যাতায়ত করেনা। এক সময় গায়ে জোড় ছিল বেশ । মানিনি জোয়ার-ভাটা। একূল থেকে ওকূল, এঘাট থেকে ওঘাট চালিয়েছি সজোরে।
শীত, বর্ষা, গ্রীষ্ম কিছুতেই হার মানিনি, নদীর বুকে দিক বেদিক ছুটে চলেছি মনের আনন্দে। সাম্পান নিয়ে যেতাম কালুরঘাট, চট্টগ্রাম মাঝির ঘাট, পতেঙ্গা এয়ারপোর্ট, সহ আর কত দুর-দুরান্তে। এখন অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। সাম্পানে দাড় নেই,সর নেই, বসেছে ইঞ্জিন, কমেছে নদীর পথে লোকজনের চলাচল।
এক সময় এই পেশায় জৌলুস ছিল। শতশত সাম্পান, নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা রাত দিন নদীর বুকে চলাচল করত। সন্ধ্যার পরে সকল নৌযানে জ্বলে উঠত হারিকেল। রাত্রে মনে হত আকাশের তারা নদীর বুকে নেমে এসেছে। খ্যাতি ছিলও বেশ। সবাই বলত কর্ণফুলির সাম্পান ওয়ালা। বিয়েসহ নানা পারিবারিক আয়োজনে নদীপথে চলাচলে সাম্পান ওয়ালার কদর ছিল অন্যরকম। সেই জৌলুস এখন আর
আগের মত নেই বলে জানান কবির মাঝি।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, একসময় এই ঘাট থেকে নদী পথে রাউজানের খেলার, পাঁচখাইন, ক
চুখাইন, নোয়াপাড়া চৌধুরী হাট, বাধেঁর গোড়া, রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী, কাউখালী, সরফভাটা, ইছাখালী, রোয়াজার হাট, বোয়ালখালীর ভান্ডালজুরি, মসজিদ ঘাট, হাজী মুন্সির ঘাট, ভাঙ্গা পুকুর ঘাট,ফকিরখালী সহ নানা ঘাটে প্রচুর লোকজন প্রতিনিয়ত যাতায়ত করত।
এখন প্রতিটি উপজেলায় সড়ক পথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে মানুষ এখন নদী পথে তেমন যাতায়ত করে না। তাই অনেকেই তার বাপ-দাদার সাম্পান চালানো পেশা ছেড়ে দিয়ে নানা পেশা যুক্ত হয়েছে। কেউ চালাচ্ছে সিএনজি চালিত অটো-রিক্সা, ভ্যান গাড়ি, কেউ করছে দিন মুজুর। কিন্তু এই ধরনের কোন পেশায় জড়িত হওয়ার মত বয়স কবির মাঝির নেই। কিন্তু এই ঘাটে নোঙ্গর করা ও চলাচলরত প্রায় প্রতিটি নৌকা- সাম্পানে ইঞ্জিন দেখা গেলেও টাকার অভাবে সাম্পানে ইঞ্জিন বসাতে পারেনি কবির মাঝি। তাই পড়ন্ত বয়সে নদীর স্রোতের সাথে প্রতিযোগীতা করে দাঁড় বেয়ে যায় কবির মাঝি।স্ত্রী, অবিবাহিত ২ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তান নিয়ে কবির মাঝির সংসার।
দাঁড় বেয়ে সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে আগ্রহ থাকলেও টাকার অভাবে মাধ্যমিকে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। তার দৈনিক আয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, সকালে এসে ঘাটে সাম্পান নোঙ্গর করি, যাত্রী হলে এঘাট থেকে ভাঙ্গা পুকুর ঘাট, হাজী মুন্সির ঘাট, মসজিদ ঘাট পর্যন্ত যায়। তাই এতে কোন দিন ২৫০, কোন দিন ২০০, আবার ১০০ টাকাও হয়। এনিয়ে চলে সংসার। কি আর করব , আল্লাহ যা মিলাই তা দিয়ে দুঃখ-কষ্টে দিন কাটায়।
এইভাবে চলছে কবির মাঝির দিনক্ষন যা বর্তমানে কর্ণফুলী নদীতে চলাচলরত প্রায় প্রত্যেক সাম্পান মাঝির জীবনের প্রতিচ্ছবি।
এ এস / জি এম এম / আর এস পি :::