করোনা-সন্দেহে জ্বরের রোগীকে চট্টগ্রামের হাসপাতালে পদে পদে নাজেহাল (ভিডিওসহ)

দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মনে বেড়েছে উদ্বেগ। ইতিমধ্যেই করোনাভাইরাস ঠেকাতে নানান প্রস্তুতির কথা জানানো হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। অথচ চট্টগ্রামে তার বাস্তব চিত্র অনেকটাই উল্টো। কেবলমাত্র করোনাভাইরাস সন্দেহের জেরে পদে পদে নাজেহাল ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এক রোগীর স্বজন। এক সপ্তাহ ধরে জ্বর, সর্দি এবং শ্বাসকষ্ট নিয়ে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার দেখিয়ে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ওই রোগী যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কর্তব্যরত চিকিৎসক করোনাভাইরাসের ‘আশঙ্কা’ জানিয়ে ওই রোগীকে ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেন।

জানা যায়, মিরসরাইয়ের বাসিন্দা ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ নুরুল হুদা চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-খুলনা-নারায়ণগঞ্জ রুটের লাইটার জাহাজের ইঞ্জিন রুমে কাজ করেন। ১৫ দিনের ছুটিতে বাড়িতে গেলে গত ৫ মার্চ জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। স্থানীয় ফার্মেসির ওষুধে না সারায় ৬ মার্চ মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে ৯ মার্চ রিলিজ হয় তার। কিন্তু বাড়িতে নেওয়ার পর জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট আরও বেড়ে যায় তার।

অবস্থার অবনতি দেখায় পরিবারের লোকজন ১০ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাকে। ভর্তিও হন সেখানে। ওয়ার্ডবয়রা ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক করোনাভাইরাসের আশঙ্কা করে রোগীকে হাসপাতালের মেডিসিন বহির্বিভাগের ৩ নম্বরে থাকা ডাক্তারকে দেখাতে বলেন। সেখান থেকে পুনরায় কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীকে নিয়ে ২১ নম্বর রুমে যেতে বলেন। রোগীর অবস্থা দেখে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক আবার ওয়ার্ডে ফেরত পাঠান। পরবর্তীতে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তিও করানো হয়। তার কিছুক্ষণ পরেই নার্স অনেকগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে দেন আর ওষুধ, স্যালাইন, ক্যানোলা আনতে বলেন। রোগীর স্বজনরা সেসব ওষুধ নিয়েও আসে। দুপুরের খাবার খেয়ে রোগীর কাছে ফিরে এলে স্বজনরা দেখেন জরুরি বিভাগে থাকা ইন্টার্ন চিকিৎসক উপসর্গ দেখে করোনাভাইরাস সন্দেহে রোগীকে হাসপাতাল ছেড়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। তবে সাদা কাগজে রোগীর স্বজন থেকে স্বাক্ষর নিতে চাইলে এ নিয়ে কথা কাটাকাটিও হয়। পরবর্তীতে কর্তব্যরত চিকিৎসক অনেকটা জোর করে হাসপাতাল থেকে ওই রোগীকে বের করে দেন। সেখান থেকে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে।

রোগীর স্বজন আব্দুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জ্বর আর শ্বাসকষ্টের কথা শুনে করোনা সন্দেহে উনারা কেউ কোথাও রাখেননি। ওষুধ আর মনগড়া কথাবার্তা বলে বের করে দেন। চমেকে একদিনের সময়ও চেয়েছি, তাও তারা রাখলেন না। সঠিক কোনো পরামর্শও দিচ্ছিলেন না। এ দুইদিনে উনার (রোগী) অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। করোনাভাইরাস সামাল দিতে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই শুনেছি। কেবল সন্দেহ— তাতেই আমাদের এমন অবস্থা। আর যদি সত্যি হয় তাহলে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে!’

জানা গেছে, হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় ১০ শয্যার ইউনিট চালু রয়েছে। রোগীর স্বজনদের তাড়াহুড়ার ভুলে ওই হাসপাতালের অন্য একটি ইউনিটে চলে যান রোগী নিয়ে। সেখান থেকে তাদের ফেরত পাঠানো হয় চমেক হাসপাতালে। উপায়ন্তর না দেখে সেদিন রাতেই রোগীকে ভর্তি করান পাহাড়তলীর বেসরকারি হাসপাতাল ইউএসটিসিতে। একইভাবে রোগীর উপসর্গ দেখে বুধবার (১১ মার্চ) সকালে পুনরায় পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়ে সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীকে বিআইটিআইডি হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দেন। দুইদিনের দৌড়াদৌড়ির পর অবশেষে রোগীকে দুপুর ২টায় ভর্তি করানো হয় ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে।

চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মূল চিকিৎসা হবে সীতাকুণ্ডের এ বিশেষায়িত হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিকভাবে দুটি কক্ষে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা করোনা ব্লক করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ৫০ শয্যার করোনা ব্লক তৈরি করা হচ্ছে সেখানে। করোনার প্রাথমিক উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের প্রথমে পাঠানো হবে বিশেষায়িত আউটডোর কক্ষে। তবে এ হাসপাতালে করোনাভাইরাসের ইউনিট চালু থাকলেও চিকিৎসা ২৪ ঘণ্টা নেই। সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহ হলে তাকে পাঠানো হবে আইসোলেশন ব্লকে। আর রোগীর অবস্থা যদি খুবই গুরুতর হয়, তাকে পাঠানো হবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এমনই সিদ্ধান্ত থাকলেও বাস্তবে সেই চিত্রের দেখা মেলেনি।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই রোগীর আরেক স্বজন জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘করোনার লক্ষণ দেখেও এমন অবহেলা! সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, কয়েকদিন ধরে করোনাভাইরাসের যথেষ্ট উপসর্গ দেখে সর্বোচ্চ আশঙ্কার পরেও এই রোগীকে নিরাপদে আনা হয়নি। একটি মাস্কও পরানো হয়নি। তার সঙ্গে এবং আশপাশেই ঘোরাফেরা করছেন অনেকে। গুরুত্ব বিবেচনায় ঢাকার পরেই চট্টগ্রাম। সেখানেই যদি চিকিৎসার এই হাল হয়, তাহলে সারা দেশের অবস্থা কী? ৫০ বছর বয়সী মানুষটিকে চিকিৎসা না দিয়ে বের করে দেওয়ার দেশে আপনি উন্নত মানুষ কিভাবে আশা করেন?’

তবে এ প্রসঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসেন উদ্দিন আহমেদ। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘তাকে কোথাও রেফার করা হয়নি। তার ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সমস্যা হয়েছে। তাকে বাসায় রেস্ট করার কথা বলা হয়েছে। বাকিটা কি করতে কী করছে সে জানে। কারণ আমাদের এখান থেকে কাউকে কোথাও রেফার করার কথা না। তার ওপর ভর্তি পেশেন্ট। আমরা সবার ওপরে। ওপর থেকে রোগী অন্য কোথাও যাবে না।’

চমেক হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘এখানে হয়তো কমিউনিকেশন গ্যাপ হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে বাসায় রেস্ট করতে। তাকে বলা হয়েছে তার ‘করোনা’ না, নরমাল ইনফ্লুয়েঞ্জা। এটা নিয়েই একটা কনফিউশান তৈরি হয়েছে। বাইরে থেকে রোগী আমাদের কাছে আসতে পারে। কিন্তু আমাদের ভর্তি রোগী সেরকম সমস্যা ছাড়া অন্য কোথাও যাবে না।’

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসেন আরও বলেন, ‘খুব ভালো একটা ইনফরমেশন দিয়েছেন। এখন রোগী বের করতে সহজ হবে। এখন আমরা এ বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য একজন লোক রেখেছি। এক বিষয় নিয়ে দুজনের কাছে গেলে এমনিতেই কনফিউশান তৈরি হয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!