করোনা ঠেকানোর অ্যাপে ৯১ লাখ টাকার ‘সহজ’ অপচয়

করোনার বিস্তার ঠেকাতে ৯১ লাখ টাকা খরচ করে তৈরি করা হয় সরকারি মোবাইল অ্যাপ ‘করোনা ট্রেসার বিডি’। এ নিয়ে বিপুল উচ্চাশা ও বিস্তর গুণগান গাওয়া হয়েছে পুরো করোনাকালজুড়ে। এমনকি সরকারি সব ওয়েবপোর্টালেই এই অ্যাপটির লিংক রাখা হয়েছে নজরকাড়া জায়গায়। শুরু থেকে বলা হয়ে আসছিল, অ্যাপটি ব্যবহার করে যে কেউ নিজেকে নিরাপদ রাখতে সক্ষম হবে। এমনকি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী কাছাকাছি আছে কিনা— সেটিও এই অ্যাপের মাধ্যমে শনাক্ত করা যাবে। বড় গলায় বলা হয়েছিল, স্মার্টফোনের ব্লুটুথ ও জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে অ্যাপটি করোনা আক্রান্ত রোগীদের শনাক্ত করে সুস্থ ব্যবহারকারীদের সতর্ক করবে।

সরকারি কর্মকর্তারাই শুধু নন, এমনকি মন্ত্রীরাও বারেবারেই শুনিয়ে আসছিলেন, ৪ জুন চালু হওয়া ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ অ্যাপটি করোনা পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

কিন্তু তিন মাস যাওয়ার পর শেষপর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ‘সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপের অসাধারণ উদাহরণ’ এই মোবাইল অ্যাপটি আসলে তেমন কোনো কাজেরই না— সরকারি অর্থের নিদারুণ একটি অপচয়। করোনা আক্রান্ত রোগীকে নির্ভরযোগ্যভাবে ট্র্যাক করা তো দূরের, এমনকি সংক্রমণ সম্পর্কে ব্যবহারকারীকে ধারণাই দিতে পারে না অ্যাপটি।

যখন বোঝা গেল, অ্যাপটি কাজের নয়। তার আগে ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ নামের এই অ্যাপটির পেছনে মোট ৯১ লাখ টাকা অপচয় হয়ে গেছে, যার পুরোটাই সরকারি তহবিল থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে অ্যাপটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি কর্মকর্তারাই বলতে দ্বিধা করেননি, ‘এটি ছিল একটি আইওয়াশ এবং সরকারের দুর্বল পরিকল্পনা ও অপচয়ের আরেকটি উদাহরণ।’

অ্যাপটি তৈরির পেছনে ছিল সরকারের আইসিটি বিভাগ। তাদের পক্ষে সেটি তৈরি করেছে সহজ ডট কম নামের একটি বেসরকারি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। তবে ‘সহজ’ নামের প্রতিষ্ঠানটি মূলত অনলাইন রাইড শেয়ারিং ও টিকেটিংয়ের প্লাটফর্ম হিসেবেই পরিচিত। সরকারের পক্ষে অ্যাপটির সঙ্গে আরও জড়িত ছিল সরকারের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানও (আইইডিসিআর)।

রাহি রহমান তার মোবাইল ফোনে ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ অ্যাপটি ইনস্টল করে দুই মাস ধরে সেটি ব্যবহার করেন। গুগল প্লে স্টোরে অ্যাপটির রিভিউতে তিনি লিখেছেন, অ্যাপটি তাকে কোনো করোনা রোগী সম্পর্কে সতর্কবার্তাও দেয়নি। এমনকি তিনি যখন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ইবনে সিনা হাসপাতালে যান, তখনও না। ‘অথচ ওই হাসপাতালটি তখন রীতিমতো করোনারোগীতে গিজগিজ করছিল। কিন্তু অ্যাপটি জানাচ্ছিল আশেপাশে কোনো করোনা আক্রান্ত রোগী নেই। এই অ্যাপটি একটি কৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয়’— লিখেছেন রাহি।

রাহিই শুধু নয়, গুগল প্লে স্টোরে ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ অ্যাপের পেইজে ব্যবহারকারীদের প্রায় সবগুলো রিভিউই নেতিবাচক। কথিত এই অ্যাপ নিয়ে প্রায় সকলেই জানিয়েছেন হতাশা, অনেকে প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ। করোনার সংক্রমণ এড়ানোর আশা নিয়ে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ এখন পর্যন্ত গুগল প্লে স্টোর থেকে ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ অ্যাপটি ডাউনলোড করেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সবমিলিয়ে ৯১ লাখ টাকার এই অ্যাপটি মূল উদ্দেশ্যটি পূরণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম আলমগীর বলেন, ‘আইইডিসিআর থেকে দেওয়া নতুন আক্রান্ত রোগীদের মোবাইল নম্বরগুলো সরকারের একসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের (এটুআই) মাধ্যমে ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ অ্যাপটির ডেটাবেজে যদি যোগ করা হয়, তাহলেই কেবল অ্যাপটি একজন ব্যবহারকারীকে করোনা আক্রান্ত কোনো রোগী কাছাকাছি আছে কিনা— সে ব্যাপারে সতর্ক করতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে আক্রান্ত রোগী ও সুস্থ ব্যবহারকারী উভয়ের ফোনেই ব্লুটুথ ও জিপিএস সক্রিয় থাকতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এছাড়া নিয়মিতভাবে ওই অ্যাপে ব্যবহারকারীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা আপডেট করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অ্যাপটি যারা ডাউনলোড করেছেন তাদের খুব কম সংখ্যকই অ্যাপে তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা আপডেট করেছেন।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী জাহিদুল ইসলাম গত ৬ জুন ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ অ্যাপটি তার মোবাইলে ইনস্টল করেন। কিন্তু তিনি অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝে যান, এটি আসলে কার্যকর কিছু নয়। এক সপ্তাহ পরেই তিনি অ্যাপটি আনইনস্টল করে ফেলেন।

অন্যদিকে ব্লুটুথ এবং জিপিএসের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে অ্যাপটি ব্যবহারকারী পর্যায়ে বেশ কিছু গুরুতর প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় ভুগেছে। যেমন রাগিব ইশরাক আলভি নামের একজন ব্যবহারকারী তার প্লে-স্টোর রিভিউতে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘এই অ্যাপটি চালাতে হলে ব্লুটুথ চালু করতে হবে, যা ফোনের ব্যাটারি বন্ধ করে দেয়। ব্লুটুথ ছাড়াও ওয়াই-ফাই এবং জিপিএসের জন্যও অনুমতি প্রয়োজন, যা ব্যাটারির আয়ু কমে যাওয়ার কারণও হতে পারে।

কৌতুকের ঢঙে তিনি আরও লিখেছেন, ‘অ্যাপটি সঠিকভাবে চালানোর জন্য একটি হাই-এন্ড প্রসেসর প্রয়োজন।’

এদিকে আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম অবশ্য বলেছেন, ‘বেশি মানুষ যদি এটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতেন তাহলে অ্যাপটির কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা যেত।’

তিনি আরও বললেন, ‘অন্তত একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে এবং আমরা এটিকে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারি।’

অ্যাপ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সহজ ডট কম নিয়মিত ডেটাবেজ আপডেট করেছে কিনা— সে ব্যাপারে কিছু জানাতে চায়নি। অন্যদিকে এই করোনা অ্যাপ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তারাও কোনো মন্তব্য করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন।

সিপি

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!