করোনা ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ‘পিয়ন টু চেয়ারম্যান’!

নির্দেশনা না মেনে হচ্ছিল সভা-বৈঠক-পরীক্ষার প্রস্তুতি

করোনা ভাইরাসে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রথম দফায় ৩১ মার্চ পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলেও চালু রাখা হয় অফিস কার্যক্রম। কিন্তু এক্ষেত্রে করোনার ঝুঁকি এড়াতে ১০ জনের জমায়েত হয়— এমন কোনো সভা-সমাবেশ না করতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়। এজন্য মন্ত্রিসভা ও মন্ত্রণালয়েরও অনেক বৈঠক বাতিল করা হয়। করোনা ঝুঁকির কারণে সব সভা-সমাবেশ বন্ধ থাকলেও চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড হেঁটেছে উল্টো পথে।

জানা গেছে, শিডিউল অনুযায়ী চট্টগ্রাম বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে ২১ মার্চ মতবিনিময় সভা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে বোর্ড অনিবার্য কারণ দেখিয়ে একদিনের সেই মতবিনিময় সভা স্থগিত করে। তবে কেন্দ্রগুলোকে ভাগ করে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে পাঁচদিনের ঘরোয়া বৈঠকের আয়োজন করে। তিন পার্বত্য জেলা ও সন্দ্বীপের কর্মকর্তাদের নিয়ে ২১ মার্চ সেই ঘরোয়া সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর মধ্যেই ২১ মার্চ ঢাকা শিক্ষাবোর্ড তাদের সকল কার্যক্রমের সভা স্থগিত করে। তবে যথারীতি চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড ২২ মার্চ কক্সবাজার জেলার ১৭ কেন্দ্রের সচিবদের নিয়ে ঘরোয়া বৈঠক চালিয়ে যায়। এর মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা আসে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করার। অথচ পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার পরও ২৩ মার্চ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা ফের সভা কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন কেন্দ্রে এইচএসসি পরীক্ষার মালামালও সরবরাহ অব্যাহত রাখে। যেখানে সরকার গণজমায়েত এড়াতে সকল সভা কার্যক্রম, নির্বাচন, পরীক্ষা স্থগিত করেছে সেখানে বোর্ড চেয়ারম্যানের কক্ষে অন্তত ২৫-৩০ জনের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে— যা সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপন্থী।

তবে এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বললেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় বলবে না ততক্ষণ অফিস বন্ধ রাখতে পারবো না। যেমন আগামীকাল থেকে বন্ধ তখন আমরা কি খোলা রাখতে পারবো? বন্ধের আগে তো বন্ধ করতে পারব না। আমরা আমাদের কাজকে গুছিয়ে স্বল্পপরিসরে যেভাবে হলে মানুষ আতঙ্কিত হবে না সেভাবে চালিয়েছিলাম। আমরা মিটিং বাতিল করে দিয়েছিলাম। মালামাল বিতরণ করে পাঁচ দিনে।’

এর মধ্যেই ঘটে গেল আতঙ্কজনক এক ঘটনা। গত ২৪ মার্চ সৌদি আরব থেকে আসা এক বৃদ্ধ নারীর শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ২১ মার্চ সেই আক্রান্ত নারীর সংস্পর্শে এসেছেন তার ছেলে কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আবু সোলায়মান। তিনি ২২ মার্চ শিক্ষাবোর্ডের সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে ভুগছেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই নিজে থেকেই হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা মানছেন।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবু সোলায়মান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উনি (মা) আসছেন ১৩ মার্চ আর করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৪ মার্চ। উনার সাথে ছোট ভাই ছিলেন। তারও কোনো লক্ষণ (করোনার উপসর্গ) নাই। পরিবারের সবাই সুস্থ আছে। এখন রিপোর্ট ভুল আসছে কিনা তাই চিন্তা করছি। মায়ের অসুস্থতা নিয়ে আমি ডেপুটি কন্ট্রোলারকে ফোন করে জানিয়েছি। উনি বলেন যে কন্ট্রোলারকে ফোন করেন। উনাকেও ফোন করেছি উনি বলছেন ব্যস্ত আছি পরে কথা বলেন। একরকম বাধ্য হয়েই মিটিংয়ে যেতে হয়েছে।’

তবে এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ বললেন ভিন্ন কথা। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা গণজমায়েত না। এটা ঘরোয়া বৈঠক। এটাতে কোনোদিন ৩০ জন ছিল না। আবার কখনো ২০ জনের বেশি ছিল না। পরের দিন ২-৩ জন বেশি ছিল তাও ১৭ জন ছিল। গণজমায়েত হবে ৫০ জন বা ১০০ জন হলে। আমাদের চেয়ারম্যানের রুমে বসতে পারে ৫০ জন। আমরা ওইভাবে দূরে দূরে থেকে চেয়ারে বসেছি। আমরা একেক জন থেকে বহু দূরে ছিলাম। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু দেখতেছি না। তাছাড়া আমরা রুমে যাওয়ার আগে হ্যান্ডওয়াশ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিয়েছি।’

নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেন, ‘মহেশখালীর একজন বলছে উনার ছেলে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসছে উনি হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। আমরা বলেছি আপনি আসবেন না। উনি যদি বলতো উনার মা অসুস্থ তাইলে কি আসতে বলতাম?’

কক্সবাজার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ নিশ্চিত করেছেন বিষয়টি তিনি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন— এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘না না। উনি? না তো। আমাকে ফোন দেয় নাই। আমি ব্যস্ত আছি এরকম বলি নাই। আমি যদি পরে কথা বলি বলবো তাহলে বলি। এগুলো সবগুলো একটা গ্রুপিং।’

এদিকে বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন কেন্দ্র সচিব জানিয়েছেন, বোর্ড চেয়ারম্যানের রুমে তিন থেকে পাঁচ ফুট দূরত্বে চেয়ার বসানোর মতো জায়গা নেই। তবে রুমে প্রবেশের আগে সকলেই হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত পরিষ্কার করেছেন। কিন্তু চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছাড়া বাকি সবাই কাছাকাছিই ছিলেন। এছাড়া তারা একে অপরের সঙ্গে হাতও (করমর্দন) মিলিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উনার (কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের মা) করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৪ তারিখ আর আমাদের মিটিং ছিল ২২ তারিখ। উনি যে সৌদি আরব থেকে আসছেন তা আমাদের জানা নেই।’

অধ্যক্ষ তো বিষয়টি আগে জানিয়েছিলেন— এমন প্রশ্নে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘না আমাদের জানায়নি। এটা মিথ্যা কথা। যদি তিনি বলে থাকেন উনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরকম আমাদের মহেশখালী কলেজের একজন বলেছেন। উনাকে আমরা আসতে নিষেধ করেছিলাম। ওনাকে কেন আসার জন্য বাধ্য করব? এরকম কেউ বাধ্য করে নাকি? এখন কেউ করোনার নাম শুনলেই দশ হাত দূরে চলে যায়।আর উনি অসুস্থ বললে ওনাকে আসতে বলবে এটা কেউ বিশ্বাস করবে?’

প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের রুমটাতে ১৩ জন অনায়াসে দূরত্ব রেখে বসতে পারে। কিভাবে বসা যায় তা তো আপনি দেখেছেন।’

ওই এক কক্ষে তো ৩০ জন ছিল— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এগুলো আগের মিটিংয়ে হয়েছিল। শনিবার যেটা মিটিং ছিল। এই মিটিং একদিনে হয়, এটাকে আমরা পাঁচ ভাগে ভাগ করেছিলাম যাতে মানুষ সমাগম কম হয়। আমরা কেউ কারও সংস্পর্শে যাইনি। তার আগে আমরা যে যার মত হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত পরিষ্কার করে রুমে গিয়েছিলাম।’

পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার পরেও কেন মিটিং— সেই প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণার পর পরই বন্ধ করেছি সব। মিটিং আরও দুইটা ছিল তা করিনি। পাঁচটার মধ্যে দুইটা বাকি আছে।’

এ অবস্থায় তিনদিনের মিটিং নিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কয়েকদিন আগে থেকেই এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। তার ওপর ঢাকা শিক্ষাবোর্ডসহ অন্যান্য শিক্ষাবোর্ডের সকল সভা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। আবার জনসমাগম এড়িয়ে চলতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকার পরেও শিক্ষাবোর্ড তাদের কার্যক্রম বহাল রেখেছে। এমনকি এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা আসার পরেও সভা করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘করোনা নিয়ে পুরো বিশ্ব আতঙ্কিত। আমরা কেউ জানি না কে এই ভাইরাসের বাহক। তাছাড়া যেখানে গণজমায়েত এড়ানোর নির্দেশ আছে, সেখানে আমাদের মিটিং হয়েছে টানা তিনদিন। এখন শুনছি মিটিংয়ে থাকা সেই অধ্যক্ষের মা করোনায় আক্রান্ত। এখন আমরা সবাই বলতে গেলে ঝুঁকিতে রয়েছি। এটা ব্লাস্ট হওয়ার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। আমার কিছু হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার জন্য অন্য কারও ক্ষতি হোক তা মেনে নেওয়া কষ্টকর।’

একই প্রসঙ্গে সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর অঞ্জন কুমার নন্দী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পিয়ন টু চেয়ারম্যান সবাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিষয়টি দুঃখজনক এবং উদ্বেগজনক। এই মিটিংয়ের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের সকলের হোম কোয়ারেন্টাইন করা দরকার। এটা আসলে আতঙ্কের বিষয়। কাউকে না কাউকে দায় নিতে হবে। বোর্ড এর দায় এড়াতে পারেন না। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।’

একই প্রসঙ্গে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির দায়িত্বে থাকা ঢাকা শিক্ষাবোর্ডর চেয়ারম্যান প্রফেসর জিয়াউল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সভা তো পাঁচ দিন হয় না। সব হয় একদিন আর পরীক্ষাসংক্রান্ত মাল বিতরণ কাল তিন বা চার দিন হয়ে থাকে। আসলে ওটা বড় সভা না। এটা এখনও বুঝতে পারছি না। নিশ্চিত হতে হবে। বোঝার বিষয় আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি সেই অধ্যক্ষ কক্সবাজারের করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে থাকে তাহলে এখানে থাকা সকলের কোয়ারেন্টাইনে চলে যাওয়া উচিত। আর যেটা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। বাকি কিভাবে এটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তা দেখতে হবে।’

প্রসঙ্গত, কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের ষাটোর্ধ্ব মা ও ছোট ভাই সৌদি আরবে ওমরাহ পালন শেষে গত ১৩ মার্চ চট্টগ্রামে ফেরেন। দেশে ফিরে তিনি নগরীর নিউ চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ৭ নম্বর সড়কের ৬৪ নম্বর ভবনের দোতলায় বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ওই ছেলের বাসায় ওঠেন। পর দিন কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কস্থ সিকদার মহল সংলগ্ন পশ্চিম পাশের বাই লেইনে পল্লবী সড়কে তার কন্যার ভাড়া বাসায় অবস্থান করেন। পরে সেখান থেকে যান দক্ষিণ টেকপাড়ায় আরেক ছেলের শ্বশুরবাড়িতে। পরে টেকপাড়া থেকে গত ১৮ মার্চ অসুস্থ অবস্থায় কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ওই মহিলাকে। ২৪ মার্চ তার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়।

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!