করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা দেখাচ্ছে আশার আলো

বিভিন্ন মেডিকেল জার্নাল ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়া রোগীর রক্তে জন্ম নেয় করোনাবিরোধী শক্তিশালী এক প্রতিরোধ ক্ষমতা। এ কারণেই একবার সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার সাধারণত এ রোগে আক্রান্ত হন না। যদিও এর ব্যতিক্রমও কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। যেমন বাংলাদেশের মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় তিন ব্যক্তি করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার ১০ দিনের মাথায় আবার আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এখনও পর্যন্ত এরকম ঘটনার সংখ্যার হাতেগোনা। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো বলছে, করোনা থেকে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর শরীরে করোনাবিরোধী প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। তারা এও ধারণা করছেন, ওই সুস্থ ব্যক্তির রক্তরস (প্লাজমা) নতুন রোগীদের জীবন বাঁচাতে পারে। এ চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলা হয় ‘কনভালসেন্ট প্লাজমা ট্রিটমেন্ট’ বা বাংলায় এটিকে বলা যায় সুস্থদের রক্তরসভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি।

সুস্থ হওয়া ব্যক্তির রক্তরস স্থানান্তর করে নতুন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার এই পদ্ধতির বিষয়ে গবেষণা এখনও চলছে। ঠিক এ কারণেই এটি অনুমোদিত চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। তবে বিভিন্ন দেশ তাদের স্বাস্থ্য বিভাগের পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে এ চিকিৎসা পদ্ধতিকে শেষ উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং এতে মিলেছে ‘সাফল্য’ও।

চীন এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ২০-২৮ শতাংশ রোগীকে ‘সুস্থ’ করে তোলা সম্ভব হয়েছে বলে জানায়। দেশটির চিকিৎসকরা দাবি করেছেন, ‘সুস্থ’ হয়ে ওঠা রোগীর রক্তরস স্থানান্তরের পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গুরুতর অবস্থায় থাকা রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছেন। তবে এ সময় রোগীদের দেওয়া হয়েছিল নিয়মিত ওষুধও।

এই তত্ত্বে বিশ্বাস রাখতে চাইছে মার্কিনিরাও। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক প্রদেশে করোনা থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের রক্তের প্লাজমা সংগ্রহ করা শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ এফডিএ (ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যডমিনিস্ট্রেশন) ইতোমধ্যে কনভালসেন্ট প্লাজমা ট্রিটমেন্টকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে এ চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করতে এফডিএর পূর্ব অনুমতি নিতে হবে। জরুরি অবস্থা হলে মৌখিক অনুমোদনেই হবে। এ চিকিৎসার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পথে হাঁটছে ভারতও।

কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপি একটি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। সর্বশেষ এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছিল আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়া ইবোলার চিকিৎসায়। তবে পূর্ণাঙ্গ ও প্রমাণিত গবেষণা না থাকায় চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে সরাসরি অনুমোদন মেলেনি স্বাস্থ্য সংস্থার। তবে করোনায় নাকাল নিরূপায় বিশ্ববাসীর জন্য সুস্থ হয়ে ফেরা রোগীদের রক্তরস অনেকটাই আশার আলো দেখাচ্ছে।

প্লাজমা ব্যাপারটি কী
প্লাজমা মানে রক্তরস। এটি হালকা হলুদাভ বর্ণের তরল যা রক্তে থাকে। মানব দেহের শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগই হল রক্তরস। ৯৫ শতাংশ হল পানি, ৬-৮% শতাংশ বিভিন্ন প্রকার প্রোটিন যেমন (অ্যালবুমিন, ইমিউগ্লোবুলিন, ফাইব্রিনোজেন)। এই ইমিউগ্লোবুলিনে থাকে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা।

করোনায় রক্তরস চিকিৎসা
রক্তরসে ২০ শতাংশ ইমিগ্লোবোলিন থাকে। ইমিউগ্লেবিনটাই হলো রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতার উৎস। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির রক্তরসের ইমিউগ্লোবুলিনে কয়েক ধরনের প্রতিরোধী ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। যেমন ইমিউগ্লোবোলিন ‘এম’ ডি’ ‘এ’ ‘বি’ ও ‘জি’। করোনা থেকে সুস্থ হওয়া রোগীর শরীরে তৈরি হয় ইমিউগ্লোবোলিন ‘এম’ ও ডি’, সেটি থাকে ৭-১০ দিনের মত। এরপরে ৩০ দিনে তৈরি হয় ‘ইমিউগ্লোবোলিন জি’ যেটি নিজের অনেক প্রতিরূপ তৈরি করে। ধীরে ধীরে এটাই বনে যায় ‘স্থায়ী প্রতিরোধী ক্ষমতা’। এ পর্যায়ে সুস্থ হওয়া ব্যক্তি পূর্ণ প্রতিরোধী ক্ষমতার অধিকারী। করোনা তাকে আর আক্রমণ করতে পারবে না। সাথে সাথে তার রক্তরস অন্যকে সুস্থ করার জন্য তৈরি হয়।

‘রক্তরস চিকিৎসা’ যে উপকারী— তার প্রমাণ কী?
রক্তরস চিকিৎসাকে পরোক্ষ চিকিৎসা ব্যবস্থা বলা হয়। ১০০ বছর আগে থেকে বিদ্যমান এ চিকিৎসা পদ্ধতি। রেবিজ, হেপাটাইটিস বি, পোলিও, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইবোলা এবং অন্যান্য কিছু রোগের চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়া গেছে। মার্স ও সার্স ভাইরাসের চিকিৎসায়ও এর ব্যবহার হয়েছে। তবে এজন্য পেতে হবে সুস্থ রোগীর প্রতিরোধী ক্ষমতা সম্পন্ন রক্তরস। এটি অবশ্যই উল্লেখ্য যে সব সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের রক্তে এটি উৎপাদিত হয় না। ভালো রক্তরসদাতাদের খুঁজে পেতে ন্যুনতম ১৫দিন সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। ক্যন্সার নিরাময়ে এ পদ্ধতি ব্যবহারের বিষয়েও গবেষণা চলমান রয়েছে।

এ পদ্ধতি আসলেই কি নিরাপদ?
প্রথমত, এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা না থাকায় এ বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ তথ্যই এখনও তত্ত্বের পর্যায়েই রয়েছে। সে কারণেই এটি এখনও অনুমোদিত চিকিৎসা নয়। দ্বিতীয়ত, সুস্থ হওয়া ব্যক্তির রক্তরসে স্থায়ী ‌‘এন্টিবডি ইমিউগ্লোবোলিন জি’ তৈরি হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। তৃতীয়ত, রক্তরসের স্থায়ী এন্টিবডি সংরক্ষণ করা প্লাজমায় কতদিন থাকবে সে বিষয়েও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না। এ কারণেই বিভিন্ন দেশে এটি মহামারির সময়ই ব্যবহার হতে দেখা যায়। তবে আরও গবেষণা হলে হয়ত একদিন রক্তরস দিয়েই সারিয়ে ফেলা যাবে কঠিন রোগগুলোকেও।

কে হতে পারেন রক্তরসদাতা?
প্রথমত সুস্থ শরীরের একজন রক্তরসদাতাকে হতে হবে ১৭ বছর বা তার বেশি বয়সের। দ্বিতীয়ত তার ওজন হতে হবে অন্তত ৪৯ কেজির বা তার বেশি। আগে তার কোভিড-১৯ পজেটিভ হতে হবে। পরে সুস্থ হয়ে রক্তদানের সময় তার কোন উপসর্গ থাকতে পারবে না।

একজন মানুষ কতজনকে রক্তরস দিতে পারবে?
একজন মানুষ দুই ব্যাগ রক্ত দিতে পারবে। দুই ব্যাগে ৪ ডোজের সমপরিমাণ রক্তরস পাওয়া যায়।

একজন রোগীকে সুস্থ করতে কত ডোজ রক্তরস লাগে?
এটি রোগীভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কেউ দুই ডোজে সুস্থ হতে পারেন। কারও ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রয়োজন হতে পারে। এ বিষয়েও চিকিৎসা পদ্ধতিতে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।

সূত্র:
১. যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন
২. এফডিএর অনুমোদন
৩. ইবোলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি
৪. সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর
৫. প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসার উত্তর
৬. কোভিড ১৯-এ প্লাজমা চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ এক্সপেরিমেন্ট
৭. প্লাজমা চিকিৎসায় উহানের এক্সপেরিমেন্ট
৮. রক্ত সংগ্রহ করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কানাডায়ও
৯. চিকিৎসায় রক্তরসের কার্যকারিতা
১০. ড. সাইয়েদ মোবিনের ( মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি) মেডিক্যাল লেকচার

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!