করোনায় অসমাপ্ত পরীক্ষা নিয়ে সংকটে চবি শিক্ষার্থীরা, জোরালো হচ্ছে পরীক্ষার দাবি

সবকিছু খুলে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় কেন বন্ধ?

করোনা সংক্রমণের শংকায় গেল মার্চের মাঝামাঝিতে বন্ধ ঘোষণা করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। এর ফলে দুই একটি কোর্স বাকি থাকতেই স্থগিত হয়ে যায় বিভিন্ন বর্ষে চলমান ফাইনাল পরীক্ষা। এদিকে এতে উভয় সংকটে পড়ে গেছেন বিভিন্ন বিভাগের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় একদিকে তারা যেমন অসমাপ্ত পরীক্ষা দিতে পারছেন না, অন্যদিকে সব কোর্সের পরীক্ষা শেষ না হওয়ায় তারা অংশ নিতে পারছেন না চলমান অনলাইন ক্লাসেও।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, করোনার কারণে বর্তমানে কোনো কিছুই থেমে নেই। সবকিছু চলছে আগের মতো। শুধু থেমে আছে শিক্ষা কার্যক্রম। ২-১টি কোর্সের পরীক্ষার জন্য তাদের সবকিছু আটকে আছে। নির্ধারিত সময়ে ফল প্রকাশিত হচ্ছে না। পরীক্ষা অসমাপ্ত থাকায় একদিকে তারা যেমন অনলাইনে পরবর্তী বর্ষের ক্লাসে অংশ নিতে পারছেন না, অন্যদিকে রয়েছে সেশনজট আর চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা। এসব কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন দিন হতাশা বাড়ছে তাদের।

শিক্ষার্থীরা দাবি তুলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেভাবে অসমাপ্ত পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে অনুমতি দিয়েছে, চবিতেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অসমাপ্ত পরীক্ষা নিয়ে নেওয়া এখন সময়ের প্রয়োজনেই জরুরি। তবে এই মুহূর্তে অসমাপ্ত পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো চিন্তাভাবনা নেই বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনা সংকটে সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষার কাজ পুরোদমে চলমান ছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগ বিভাগ সম্পূর্ণ পরীক্ষা শেষ করলেও কিছু বিভাগ পরীক্ষার মাঝামাঝিতে এসে আটকে যায়। এসব বিভাগের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা, সমাজতত্ত্ব ও আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা, রাজনীতি বিভাগের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষ, লোক প্রশাসন ও সংস্কৃত বিভাগের মাস্টার্স, হিসাব বিজ্ঞান ও মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের দুটি ব্যাচের ইন্টারশিপের মৌখিক পরীক্ষা, ফার্মেসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের তিনটি ব্যবহারিক পরীক্ষা।

এছাড়া অর্ধেকের মধ্যে আটকে আছে গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের ব্যবহারিক, ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মৌখিক ও ব্যবহারিক, ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অষ্টম সেমিস্টার, ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ, ওশানোগ্রাফি বিভাগের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষ ও ফিশারিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে অসমাপ্ত পরীক্ষা বিভাগগুলো চাইলে নিয়ে নিতে পারবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আবাসিক হলগুলো বন্ধ থাকবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও মৌখিক পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া শুরু করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কমিটি গঠন করেছে। পাশাপাশি পরীক্ষা সমাপ্ত না হলেও পরবর্তী বর্ষের ক্লাস অনলাইনে শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে এসবের কোনো কিছু নিয়েই এখন পর্যন্ত ভাবছে না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাদিয়া জাহান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা মাত্র তিনটি হয়েছে। পাঁচটি পরীক্ষা এখনও বাকি রয়ে গেছে। করোনার কারণে পরীক্ষা আটকে থাকায় আমরা সেশনজটে পড়ে যাচ্ছি এবং আমাদের অনার্সও শেষ হচ্ছে না। তাই আমরা চাকরির জন্যও আবেদন করতে পারছি না। সে কারণে দিন যত যাচ্ছে, আমাদের হতাশাও ততো বাড়ছে। আমরা অনিশ্চয়তায় ভুগছি, কখন ক্যাম্পাস খুলবে? আর কখন আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে? তাই বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের কাছে আমাদের আবেদন, যে কোন উপায়ে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের পরীক্ষাগুলো যাতে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।’

রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইমরান বলেন, ‘আমাদের যাদের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা আটকে আছে, আমরা জবে অ্যাপ্লিকেশন করতে পারতেছি না। অনলাইনে মাস্টার্সের ক্লাসও শুরু করতে পারতেছি না। যেখানে আমাদের মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালে, সেখানে আমাদের অনার্সও শেষ হয়নি এখনও। এদের মধ্যে অনেকের ১-২ বছর গ্যাপ আছে। চাকরির জন্য আবেদন করার সময় নিয়ে এখন আমরা উদ্বিগ্ন। যার কারণে আমরা অনেক মানসিক অবসাদে আছি। অনেকের ফ্যামিলির অবস্থাও ভাল না। যাদের অভিভাবকরা গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল, তারা হতাশ।’

শাহরিয়ার আরও বলেন, ‘দেশের সবকিছু স্বাভাবিক গতিতে চলছে। বাসে মানুষ ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে, ট্রেনেও ভিড়। পর্যটন কেন্দ্রগুলোও খুলে দেওয়া হইছে। হাটবাজারও লোকারণ্য। আন্দোলনও চলছে; করোনা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে । এমন অবস্থায় দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে, এসব ছাত্রদের দুর্দশা-দুর্ভোগ বাড়ানো আর জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা অযৌক্তিক। দয়া করে আমাদের করোনার প্রভাবে মাইরেন না, প্রয়োজনে করোনায় মরতে দিন।’

ভুগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ‘করোনা বলে কোন কিছুই থেমে নেই। সবকিছুই প্রায় স্বাভাবিক গতিতে চলছে, শুধুমাত্র শিক্ষাখাত ছাড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেরা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। সুতরাং করোনার অজুহাতে মাসের পর মাস এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখার কোন মানে হয় না। আমরা সরকার ও ইউজিসির কাছে জোরালো দাবি জানাই, অন্ততপক্ষে যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিয়ে যেন অসমাপ্ত পরীক্ষাগুলো শেষ করে তাড়াতাড়ি ফলাফল প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। না হয় লাখো মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যার দায় কিছুতেই সরকার ও ইউজিসি কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারবে না।’

স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর এসএম মনিরুল হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের এখনও চিন্তাভাবনা নেই। কারণ আমাদের বিষয়টা অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমাদের সব ছাত্র ক্যাম্পাসে থাকতে পারে না। পরীক্ষা নিতে হলে হল খুলে দিতে হবে। হল খুলে দিলে ব্যবস্থাপনার ব্যাপার আছে, করোনার ঝুঁকি আছে। এক্ষেত্রে দায়িত্বটা কে নেবে?’

তিনি বলেন, ‘আমরা চিন্তা করতেছি সরকারের কোনো সংকেত পেলে একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে নেবো।’

পরীক্ষা ছাড়া পরবর্তী বর্ষে অনলাইনে ক্লাসের অনুমতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা আছে।’

এমআইটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!