‘করোনার ৩৪ রূপ’ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও দেখা মেলেনি—চট্টগ্রামে সবচে বেশি

চলতি মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশে আবারও বাড়তে শুরু করেছে করোনার সংক্রমণ। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রতিদিনই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। এরইমধ্যে করোনার যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ভ্যারিয়েন্টও পাওয়া গেছে বাংলাদেশে। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা জানালেন আরও ভয়ংকর তথ্য। দেশে ২০২০ সালে সাড়ে চার হাজারের বেশিবার রূপ বদল করেছে করোনা। ৩৭১ নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স থেকে নতুন ধারার ৩৪টি একেবারে নতুন মিউটেশন বা রূপ পাওয়া গেছে। গবেষকেরা এর নাম দিয়েছেন বাংলা মিউটেশন। এগুলোর সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র পরিবর্তন দেখা গেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে।

২০২০ সালে বাংলাদেশে সার্স কভ-২ এর জিনোমে পাওয়া গেছে বেশকিছু নতুন ধারার পরিবর্তন। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর এর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে এই ভাইরাসের জিনোমে দেখা গেছে ৪৬০৪ রকমের ভিন্নতা। পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায়নি এরকম নতুন ধারার পরিবর্তন। বিজ্ঞানীরা এটাকে বলছেন, ইউনিক মিউটেশন। বাংলাদেশে এই ইউনিক মিউটেশন পাওয়া গেছে ৩৪টি।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা ‘এলসেভিয়ার’ এবং নেদারল্যান্ডসের ‘ভাইরাস রিসার্চ’-এ প্রকাশিত জার্নাল থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারটি প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের বাংলাদেশের ২০২০ সালের জিনোম সিকুয়েন্সগুলো নিয়ে বিশ্লেষণী গবেষণাপত্র মূলত এই জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণাপত্রে দেখা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি নতুন ধারার জিনগত পরিবর্তন তথা ইউনিক মিউটেশন পাওয়া গেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে (৩টি করে)। সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময় জিনোম সিকুয়েন্স পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এখানে একই সঙ্গে সৌদিআরব তথা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্সের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে বাংলাদেশের ভাইরাসের জিনোমগুলোর।

এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ অঞ্চলের জিনোম সিকুয়েন্সের ভাইরাস। এছাড়াও পৃথিবীব্যাপী সার্স কভ-২ এর যে পরিবর্তনটিকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংক্রমণশীল বলে বিবেচনা করা হয়েছে, সেই জি৬১৪ডি মিউটেশন ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি সিকুয়েন্সের মধ্যেই ছিল।

এতে আরও দেখা যায়, বাংলাদেশে ভাইরাসের ডি৬১৪জি অংশের মিউটেশন বা পরিবর্তন যেখানে যেখানে দেখা গেছে সেসব জায়গাতেই জিনগত পরিবর্তনের হার অনেক বেশি এবং এই পরিবর্তনটিই হয়তোবা ২০২০ সালের মাঝামাঝি দেশে সংক্রমণের হার বেশি থাকার অন্যতম কারণ হয়ে থাকতে পারে। এছাড়াও নন-স্ট্রাকাচারাল প্রোটিন বা এনএসপি প্রোটিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র জিনগত পরিবর্তন পাওয়া গেছে বাংলাদেশে।

গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক মাহবুব হাসান ও আদনান মান্নান এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউএসটিসি) শিক্ষক রাসেল দাশ। এছাড়াও তত্ত্বাবধানে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এম মাহবুবুর রশিদ ও ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জুনায়েদ সিদ্দিকি। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে ছিলেন মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হামিদ হোসাইন, নাজমুল হাসান এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসমা সালাউদ্দিন, রাশেদুজ্জামান ও মেহেদী হাসান।

ডিসেম্বরের শুরুর দিক পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ডাটাবেস ‘গ্লোবাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্স অ্যান্ড রেসপন্স সিস্টেম’-এ জমাকৃত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পুর্ণাঙ্গ ও সম্পূর্ণ জিনোম সিকুয়েন্সগুলো নিয়ে করা এই গবেষণায় বাংলাদেশি সার্স কভ-২ এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সার্স কভ-২ এর জিনোম সিকুয়েন্সের।

গবেষক দলের প্রধান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আদনান মান্নানের মতে, “এই মিউটেশন বা জিনগত ভিন্নতার কারণে ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না তা খতিয়ে দেখা খুব গুরত্বপূর্ণ। কোনো বিশেষ উপসর্গের পেছনে এরকম ইউনিক বা বাংলাদেশে স্বতন্ত্র মিউটেশনগুলো দায়ী কি না, কিংবা এই ধরনের মিউটেশন থাকলে রোগীরা উপসর্গবিহীন হয় কি না সেটাও দেখা প্রয়োজন। কারণ ‘নিউ মাইক্রোবস অ্যান্ড নিউ ইনফেকশন’ নিবন্ধে প্রকাশিত আমাদের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক দেশে আনুপাতিক হারে উপসর্গবিহীন কোভিড-১৯ এর রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।”

গবেষক দলের অন্যতম প্রধান ইউএসটিসির শিক্ষক রাসেল দাশ বলেন, ‘গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিক হলো বাংলাদেশের ইউনিক মিউটেশনগুলো অঞ্চলভিত্তিক। যেমন কিছু কিছু জিনগত পরিবর্তন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু জেলা বা অঞ্চলেই দেখা গেছে। ঢাকায় তিনটি সুনির্দিষ্ট জিনগত পরিবর্তন দেখা গেছে। যেটা শুধু ঢাকার রোগীদের মধ্যেই ছিল, আর কোথাও দেখা যায়নি। একইভাবে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, বরিশাল, যশোর, মৌলভীবাজার ও ময়মনসিংহে নিজস্ব জেনেটিক ভিন্নতা ছিল। এক্ষেত্রে সেসব জেলার ভৌগলিক অবস্থান, জীবনযাপন এবং পরিবেশগত নিয়ামকগুলো হয়তো ভাইরাসকে বদলে দিতে ভূমিকা রেখেছে।’

গবেষণা কাজের সমন্বয়কারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুব হাসানের মতে, ‘এতগুলো ইউনিক মিউটেশন থাকলে খুব বড় একটা সম্ভাবনা থাকে দেশে নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট বা প্রকরণ উদ্ভব হওয়ার। এক্ষেত্রে এসব মিউটেশন বহন করা ভাইরাসগুলো গবেষণাগারে দ্রুত নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং দেখা উচিত তা কি ব্রিটিশ কিংবা আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের মতো বাংলাদেশি বা বাংলা ভেরিয়েন্টের কোনো নতুন প্রজাতির ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না। এবং দিলে আদৌ তা সংক্রমণশীল কিংবা ভয়াবহ আকার ধারণ করে কি না।’

গবেষকদলের মতে, বাংলাদেশের নতুন জিনগত মিউটেশনগুলোর বিরুদ্ধে সম্প্রতি উদ্ভাবিত ও প্রয়োগকৃত ভ্যাকসিন কার্যকর কি না সেটাও গবেষণা করে দেখা জরুরি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রোগীদের জন্য ভ্যাকসিনের নকশাতে কোনোরকম পরিবর্তন আনা দরকার কি না তা খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন গবেষকেরা।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান বলেন, ‘দেশের ইউনিক মিউটেশনগুলো অঞ্চলভিত্তিক। কিছু জিনগত পরিবর্তন শুধু নির্দিষ্ট জেলা বা অঞ্চলেই পাওয়া গেছে। ঢাকায় দেখা গেছে তিনটি নির্দিষ্ট জিনগত পরিবর্তন। একইভাবে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, বরিশাল, যশোর, মৌলভীবাজার এবং ময়মনসিংহেও আলাদা মিউটেশন পাওয়া গেছে।’

ইউনিক মিউটেশন বেশি থাকায় নতুন যেকোনো ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। ফলে এলাকাভিত্তিক জিনোম সিকোয়েন্স করা জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, শক্তিশালী জি-৬১৪-ডি মিউটেশন ৯৮ ভাগ।

বাংলাদেশে করোনার নতুন জিনগত মিউটেশনের বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে এএমএএম জুনায়েদ সিদ্দিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই গবেষণার মাধ্যমে দেশে পাওয়া সার্স কোভ-২ মিউটেশনগুলো নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। বিশেষ করে যারা বিদেশ থেকে এসেছেন এবং যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন, তাদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে খুঁজে বের করতে হবে যে, তারা নতুন কোনো মিউটেশনে আক্রান্ত কি না। কিংবা তাদের শরীরে ভ্যাকসিন কাজ করছে কি না।’—সারাবাংলাডটনেট অবলম্বনে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!