করোনার ‘নেগেটিভ’ সনদ দিতে চট্টগ্রামে শিকার ধরতেন আহাম্মদ হোসেনের টিম

পজিটিভকে নেগেটিভ করার আশ্বাসে কোটি কোটি টাকার প্রতারণা

বিদেশগামী যাত্রীর ছদ্মবেশ নিয়ে চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে অবস্থান করতেন আহাম্মেদ হোসেন ও তার এজেন্টরা। নিজেরাও বিদেশগামী যাত্রী— এমন পরিচয় দিয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়ানো মধ্যপ্রাচ্যগামী সাধারণ যাত্রীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতেন। দ্রুত সেই নম্বর চলে যেতো বেলাল ও সবুজ নামের দুই প্রতারকের কাছে। বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের প্রকৃত করোনা টেস্টের ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই বেলাল ও সবুজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের করোনা টেস্ট বিভাগের ডাক্তার অথবা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ পরিচয় দিয়ে টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে বলে জানাতেন তারা। পরে পজিটিভ থেকে নেগেটিভ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিতেন।

করোনার ‘নেগেটিভ’ সনদ দিতে চট্টগ্রামে শিকার ধরতেন আহাম্মদ হোসেনের টিম 1

চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এরকম এক সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্রের খোঁজ পেয়েছে র‌্যাব। বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেস্টের ফলাফল বদলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতারকচক্রের ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চক্রটি প্রায় এক বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানী ঢাকা, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাব-১১ অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেফতার এই প্রতারকরা হলেন— জসিম উদ্দিন (২২), সুলতান মিয়া (১৯), বেলাল হোসেন (৩১), আবুল হোসেন (২৪), আব্দুর নূর (২১), আলফাজ মিয়া (১৯) শামিম (৩২), আহাম্মদ হোসেন (১৯), ইমরান উদ্দিন মিলন (১৯), সবুজ মিয়া(২৭), আব্দুর রশিদ (২৮), আব্দুল করিম চৌধুরী (৩২) আঙ্গুর মিয়া (২৫) ও আলমগীর হোসেন (২০)।

এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে আয় করা সাত লাখ টাকা, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১২০টি সিমকার্ড, ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন, ট্যাব, ৩২টি মোবাইল ফোনসেট, একটি পাসপোর্ট, নোটবুক এবং চক্রের সদস্যদের বেতনের হিসাব বিবরণী জব্দ করা হয়।

র‌্যাব জানিয়েছে, এই চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তাদের টার্গেট মূলত বিদেশগামী যাত্রীরা। এসব মানুষের যারা তথ্য সংগ্রহ করতেন তাদেরকে দৈনিক ভিত্তিতে এক হাজার টাকা দেওয়া হতো। যারা মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করতেন তাদেরকে দৈনিক ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা দেওয়া হতো। এছাড়াও চক্রের সদস্যদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে আলাদা আলাদা সেক্টরে কাজ করতে বলা হতো। কেউ মোবাইল ব্যাংকিং, হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ, মোবাইলে কথা বলা, পজিটিভ থেকে নেগেটিভ রিপোর্ট করাসহ নানা সেক্টরে কাজ করতেন তারা।

র‌্যাব বলছে, এই চক্রটির কোনো হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তারা প্রথমে করোনা টেস্টের নমুনা দিতে আসা মানুষের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতেন। এরপর তাদের ফোন করে করোনা পজিটিভ বলে জানাতেন। এ সময় করোনা টেস্টের ফল পরিবর্তন করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিত চক্রটি। এভাবে চক্রটি কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছে।

একসময় ফেরি করে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করতেন বেলাল হোসেন। কিন্তু এতে আর্থিক টানাপোড়েন কাটছিল না তার। পরে অনেক চেষ্টায় মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে কাজের সুযোগ পান বেলাল। সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করে সরকারি নিয়ম মেনে গত বছরের (২০২১ সালের) মার্চ মাসে কুমিল্লার একটি হাসপাতালে করোনা টেস্টের নমুনা দেন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ওই হাসপাতালের চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে জানান, ‘বেলালের করোনা টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে। কিন্তু তার করোনার ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব। এ জন্য দিতে হবে ১০ হাজার টাকা।’

টাকা দেওয়ার পরেও মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে করোনার ফলাফল পজিটিভ আসে। বিশ্বাস করে টাকা দিয়েও বিদেশে না যেতে পেরে হাসপাতালে যোগাযোগ করেন বেলাল। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা ব্যক্তি ওই হাসপাতালে কাজ করেন না। এসময় বেলাল বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। পরে একই বছরের এপ্রিল মাসে করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসার পর মধ্যপ্রাচ্যে যেতে পারেন বেলাল।

তবে এর আগে করোনা টেস্ট করতে গিয়ে প্রতারণার বিষয়টি মানতে পারেননি বেলাল। তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ বিচার বিশ্লেষণ করেন। যেভাবে তিনি নিজে প্রতারণার শিকার হয়েছেন, একইভাবে বিদেশগামীদের কাছ থেকে করোনার টেস্টের ফল পরিবর্তন করে দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করেন। সেই অনুযায়ী বিদেশে যাওয়ার আগে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সবুজকে নিয়ে একটি চক্র গড়ে তোলেন বেলাল। বন্ধু সবুজের সঙ্গে হাতিয়ে নেওয়া টাকার ভাগাভাগির চুক্তি করে বেলাল চলে যান মধ্যপ্রাচ্যে। এভাবেই প্রতারণার শিকার বেলাল হয়ে উঠলেন অভিনব এক প্রতারক চক্রের হোতা।

গ্রেফতার প্রতারক চক্রের সদস্যদের বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আহাম্মেদ হোসেন চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আবুল হোসেন নারায়ণগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, আব্দুর নূর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়, আব্দুর রশিদ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আব্দুল করিম কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়, আলমগীর সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায়, আঙ্গুর মিয়া কুমিল্লা, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় করোনা টেস্টের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে সকাল সাতটা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অবস্থান করতেন। এ সময় তারা বিদেশগামী যাত্রী ছদ্মবেশে অবস্থান নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতেন।

নম্বর সংগ্রহ করে বেলাল ও সবুজকে পাঠাতেন তারা। বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের প্রকৃত করোনা টেস্টের ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই বেলাল ও সবুজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের করোনা টেস্ট বিভাগের ডাক্তার অথবা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ পরিচয় দিয়ে টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে বলে জানাতেন। পরে পজিটিভ থেকে নেগেটিভ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিতেন।

চক্রের অন্য সদস্য আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান একই সময়ে বেলাল ও সবুজকে বিভিন্ন জায়গার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নাম্বার সরবরাহ করতেন। ভুক্তভোগীরা বেলাল ও সবুজের কথা অনুযায়ী টাকা পাঠালে আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান তা সংগ্রহ করতেন। টাকা সংগ্রহের অবস্থান সব সময় ভিন্ন ভিন্ন জেলায় নির্ধারণ করা হতো, যাতে কেউ প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে না পারেন। একটি সিম একদিন ব্যবহার করে তা কিছুদিন বন্ধ রেখে পুনরায় ব্যবহার করা হতো। তবে কোনো ফোন নম্বর নিয়ে সন্দেহ হলে তা ফেলে দিতেন তারা। প্রতারণার পুরো কাজটি করতে যেসব সিম ব্যবহার করা হতো সেগুলো সরবরাহ করতেন মিলন। ১২০ টাকায় কেনা সিম চক্রের কাছে এক হাজার টাকায় বিক্রি করা হতো।

চক্রের কাছে শতাধিক সিম সরবরাহ করে আসছিলেন ইমরান উদ্দিন মিলন। তিনি ফুটপাতে সিম বিক্রির আড়ালে সাধারণ মানুষের ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যবহার করে সু-কৌশলে শত শত মোবাইল সিম তুলে নিতেন। তিনি রাস্তার পাশে মোবাইল সিম বিক্রির নামে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের কাছ থেকে বারবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে একাধিক সিম নিজে রেখে দিতেন। ১২০ টাকায় কেনা প্রতিটি সিম ওই চক্রের কাছে এক হাজার টাকা করে বিক্রি করতেন মিলন।

র‌্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক জানান, প্রতারণার মাধ্যমে চক্রটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। চক্রের সদস্য সবুজ এক বছরে হাজারের অধিক বিদেশগামী যাত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। চক্রটি প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিতো। সবুজ এই টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে একটি ভবন তৈরি করেছেন। অন্যদিকে বেলাল হোসেন প্রতারণার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে যাতায়াত করেছেন। বেলালও ছয় শতাধিক বিদেশগামী যাত্রীদের সঙ্গে একই কায়দায় প্রতারণা করেছেন। এভাবে ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য জানিয়েছেন তিনি। চক্রের অন্য সদস্যরা প্রতিদিন হাজিরাভিত্তিতে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা করে পেতেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!