করোনার টিকা চুরি করে ‘হোম ডেলিভারি’ দেন চসিকের কর্মীই, এক হাজারে ‘কন্ট্রাক্ট’

টিকার অবৈধ বাণিজ্যে আরও কারা, চলছে খোঁজ

চট্টগ্রামে বাসায় গিয়ে টিকা দেওয়ার ঘটনায় এবার জড়িয়ে গেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নামও। জানা গেছে চসিকের টিকাদান কেন্দ্র মোস্তফা হাকিম ডিগ্রি কলেজ কোভিড ভ্যাকসিন কেন্দ্র থেকেই এক স্বাস্থ্যকর্মীর যোগসাজশে বাসায় গিয়ে টিকা দেওয়ার এই কার্যক্রম চলছিল। বাসায় গিয়ে টিকা দেওয়ার জন্য চসিকের ওই স্বাস্থ্যকর্মী বিষু দে টিকাপ্রতি ‘কন্ট্রাক্টে’ নিচ্ছিলেন এক হাজার টাকা।

চট্টগ্রামে যখন টিকা দেওয়া নিয়ে নাগরিকদের চরম ভোগান্তির ধারাবাহিক ঘটনা ঘটছে, সে সময়ে ঘরে বসে টিকা পাওয়ার এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন নাগরিকরা। প্রশাসনও এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে করোনার টিকা নিয়ে এমন অবৈধ বাণিজ্য আরও ঘটেছে কিনা— তা নিয়েও প্রশাসনের বিভিন্ন মহল থেকে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

এর আগে ‘চট্টগ্রামে ভিআইপি টিকার রমরমা ব্যবসা চসিকের হাসপাতালেই, রয়েছে দুই নাম্বার টিকাও’ এবং ‘চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে করোনার টিকা বেচে কথিত সুইপার, দিনে আয় ১ লাখ’ শিরোনামে গত ৬ জুলাই ও ১০ জুলাই চট্টগ্রাম প্রতিদিনে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে পরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।

আলোচিত এই ঘটনায় চসিকের জোনাল মেডিকেল অফিসার ডা. তপন কুমার চক্রবর্তী (৫১) বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন।

সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করা হয়, ‘বিষু দে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সরকারঘোষিত কেন্দ্রে টিকা প্রদান না করে সে ও তার অন্যান্য অজ্ঞাত সহযোগীদের সহায়তায় ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য বিনামূল্যে প্রদানকৃত কোভিড ভ্যাকসিন চুরি ও আত্মসাৎপূর্বক বাসায় গিয়ে অর্থের বিনিময়ে প্রদান করেছিলেন।’

সেই মামলাতেই মোস্তফা হাকিম ডিগ্রী কলেজের স্বাস্থ্যকর্মী বিষু দে (৩৫) কে ৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এছাড়া মামলায় ব্যাংকার মোবারক আলী ও টিকা নেওয়া হাসান ছাড়াও তাদের আরেক বন্ধু সাজ্জাতকেও আসামি করা হয়েছে।

সিএমপির খুলশী থানা সূত্রে জানা গেছে শনিবার ‘এমডি হাসান’ নামে নিজ ফেসবুক আইডিতে টিকা গ্রহণের ছবি পোস্ট করে লেখেন ‘ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অশেষ ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু মো. মোবারক আলীকে কোভিড ভ্যাকসিন প্রদানে সহায়তা করার জন্য। আলহামদুল্লিাহ মর্ডানার প্রথম ডোজ সম্পন্ন।’

টিকা নিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে ঘরে বসে টিকা দেওয়ার এমন ছবি নিয়ে তাৎক্ষণিক তুমুল সমালোচনা শুরু হয় ফেসবুকে। এর প্রতিক্রিয়ায় রাতেই হাসানকে আটক করে খুলশী থানা পুলিশ। এরপর সকালে টিকা সরবরাহে সহযোগিতাকারী মোবারক আলীকেও আটক করা হয়।

খুলশী থানার ওসি মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই ঘটনাটি আমরা খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। এর মধ্যে চসিকের একজন ডাক্তার একটা মামলা করেছেন। মোস্তাফা হাকিম টিকাদান কেন্দ্রের এক স্বাস্থ্যকর্মীও এর সাথে জড়িত। তাকে আসামী করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

চট্টগ্রামে করোনার টিকা দেয়ায় চসিকের স্বাস্থ্যকর্মীদের অনিয়মের এটাই প্রথম ঘটনা নয়। এর আগেও হাজার টাকার বিনিময়ে চসিকের কর্মীদের টিকাদানের অভিযোগ নিয়ে অভিযোগ ছিল। সেসব নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে করোনার টিকা নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বহু অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে জনমনেও।

গত ১০ জুলাই চট্টগ্রাম প্রতিদিনে ‘চট্টগ্রামে ভিআইপি টিকার রমরমা ব্যবসা চসিকের হাসপাতালেই, রয়েছে দুই নাম্বার টিকাও’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাটের কালিবাড়ি রোডে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত জেনারেল হাসপাতালে করোনা টিকার অবৈধ বাণিজ্য চলছে প্রকাশ্যেই। টিকাপ্রতি সেখানে নেওয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন ১৪০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যৌথ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে টিকার এই কারবার। এজন্য তারা আশ্রয় নিচ্ছে অভিনব সব কৌশলের। অন্যদিকে চসিকের এই হাসপাতালে কর্মরত একাধিক কর্মী এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকলেও হাসপাতালেরই একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন, টিকাদানে নিয়োজিত দুজন কর্মী ছাড়া বাকিদের দেওয়া টিকা পুরোটাই ‘দুই নাম্বার’।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধানে জানা যায়, সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালে করোনার দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে আসা প্রার্থীদের প্রথমে টিকার সংকট দেখিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে এদের মধ্যে যারা বিশেষ এজেন্ট বা কর্মকর্তা-কর্মচারীর রেফারেন্সে আসেন তারা টিকা পান। আবার যারা টিকার জন্য পীড়াপিড়ি করেন, তাদের কৌশলে বশে এনে টাকার বিনিময়ে টিকা ‘ম্যানেজ’ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

অন্যদিকে গত ৬ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী গলিতে করোনার সরকারি টিকার ‘দ্বিতীয় ডোজের’ জমজমাট ব্যবসা নিয়ে ‘চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে করোনার টিকা বেচে কথিত সুইপার, দিনে আয় ১ লাখ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম প্রতিদিনে। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘অস্থায়ী কর্মচারী’ হিসেবে এলাকায় পরিচয় দেওয়া এক লোক নগরীর হাজারী গলির একটি ঘরে নিজ হাতেই দিচ্ছেন করোনা টিকার ‘দ্বিতীয় ডোজ’। তবে চসিক সূত্রে জানা গেছে, বলয় আদৌ চসিকের পরিচ্ছন্নকর্মী নন।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!