করোনায় ধর্ষণের মহামারী; বিচারহীনতাই মূল কারণ!

করোনা মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে পঙ্গু করে দিয়েছে, তবে থামাতে পারেনি অপরাধ৷ বর্তমানে করোনাকালে দেশে অপরাধের গ্রাফ সমানে উপরে উঠেছে৷ সাধারণ মানুষ করোনার ভয়ে যতই মাস্ক পরে, সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে ভয়ে ভয়ে বাস করুন না কেন, অপরাধীরা করোনার ভয় থেকে মুক্ত৷ না হলে এই করোনার মধ্যেও কেন থেমে নেই অপরাধ। অপরাধীরা ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন থেকে শুরু করে উত্যক্ত করা- সব কাজই তারা করছে৷

করোনাভাইরাস যেখানে সবকিছু থমকে দিয়েছে, তখন আরও দুঃসংবাদের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। গত কয়েকদিনে একাধিক ধর্ষণের খবর। আমার এই লেখা পর্যন্ত ধর্ষণের সবশেষ খবরে ভেসে আসে সাভারের আশুলিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে আটকে বিচারপ্রার্থী এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাহাড়, যশোর থেকে সাভার, গাইবান্ধা, সিলেট কিংবা রাজনৈতিক সহকর্মী; নারী কোথাও নিরাপদ নয়। এ যেন এক হৃদয়বিদারক অশনিসংকেত।

এরমধ্যে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। ৯ জন ধর্ষক একটি আদিবাসী চাকমা পরিবারের ঘরে ঢুকে বাবা আর মাকে আটকে রেখে সারারাত প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে বলে গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে। একইদিনে যশোরেও দু’জন কিশোরী মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত ৭ এপ্রিল করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যেই গাজীপুর শহরে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রেমিকাকে ডেকে এনে বন্ধুদের নিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনার পর ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে বলে জানা গেছে।

খুলনা করোনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা আক্রান্ত এক তরুণী (২৬) রোগীকে যৌন হয়রানিসহ ধর্ষণ চেষ্টা করেছে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিযুক্ত এক ওয়ার্ডবয়। অবশ্য ইতোমধ্যেঙ ধর্ষণবিরোধী প্রবল জনমতের চাপে পাহাড়ের ধর্ষকদের গ্রেপ্তারে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সিলেটের ঘটনায়ও নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এদিকে সাভারে ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় করে হাসপাতালে যাওয়ার পথে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া বোনকে ভাইয়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পালপাড়া মহল্লার একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে নিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাহত করে হত্যা করে স্থানীয় বখাটে মিজানুর রহামন চৌধুরী। নীলার পরিবারের দাবি, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নীলাকে হত্যা করে মিজানুর। সে স্থানীয় একটি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

জানতে পেরেছি, কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার এক তরুণী (১৬) গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে তিশা প্লাস পরিবহনের একটি বাসযোগে কুমিল্লা শহরের শাসনগাছার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। ওই তরুণী বাসের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারকে শাসনগাছা বাস স্টেশনে তাকে না নামিয়ে কৌশলে বাসটি জেলা সদরের অদূরে সদর দক্ষিণ থানাধীন পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডের আল-শাকিল হোটেলের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে ভোররাতে খালি বাসের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে ওই তরুণীকে হেলপার বাবু শেখ, চালক আরিফ হোসেন সোহেল ও সুপারভাইজার আলম মিলে ধর্ষণ করে। পরে ওই তরুণীকে পদুয়ার বাজার এলাকায় বাবু শেখের বসতঘরে নিয়ে পুনরায় ধর্ষণ করা হয়।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক তরুণীকে (২০) দুইদিন ধরে আটকে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

আমি আশা করি, ধর্ষণের সবগুলো ঘটনায় অপরাধীরা দ্রুত গ্রেপ্তার হবে। এ অপরাধীদের আইনের আওতায় না আনলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, যা কখনোই কাম্য নয়। সিলেটের এমসি কলেজ হোস্টেল এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলন এক দম্পতি। এসময় ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয়দানকারী সাইফুর, শাহ রনিসহ কয়েকজন স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে। এ ঘটনায় পুলিশ গিয়ে হোস্টেলের সামনে থেকে ধর্ষণের শিকার নারীকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসের ফটকের বাইরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। তারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে। শিক্ষার্থীরা এসময় সিলেট-তামাবিল সড়ক অবরোধ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পুলিশও ধর্ষকদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে।

এসব ঘটনাপ্রবাহ ইতিবাচক। তবে শেষ পর্যন্ত ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারের কোনো বিকল্প নেই।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। তারমধ্যে ২০১৭ সালে ৮১৮ জন, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল ৭৬ জনকে। আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছিলেন ১০ জন নারী।

ধর্ষণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে শুধু আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয় বলে আমি মনে করি। এজন্য প্রয়োজন আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন ও সামাজিক আন্দোলন। নারীর অগ্রগতির পথে এ ঘৃণ্য কর্মকান্ড বিরাট অন্তরায়। এজন্য কঠোরভাবে আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।

আমি মনে করি, দুর্বল আইনকানুনকেই অনেকে ধর্ষণের বাড়বাড়ন্তর জন্য দায়ী করে থাকেন। গণধর্ষণের মূল কারণ বিচারহীনতা এবং এদের কাউন্সেলিং করার ব্যবস্থা না থাকা৷ অথচ কিশোরদের জন্য এটা খুব দরকার৷

লেখক : চেয়ারম্যান, এলবিয়ন গ্রুপ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!