করোনাকালে ভালোবাসার মায়া ছড়িয়ে যাচ্ছে একদল তরুণ

গৃহকর্তার হয়েছিল করোনা। বাড়ির সবাই নিরাপদ দূরত্বে থেকে তার সেবাযত্ন করার জন্য পাঠায় অসহায় কাজের মেয়েটিকে। সেবা দিতে দিতে ১২-১৩ বছরের কিশোরীটিও অবধারিতভাবে কিছুদিনের মধ্যেই আক্রান্ত হয় করোনায়। কিন্তু করোনা ধরা পড়ার পরই পরিবারের সবার তখন অন্য চেহারা! তাকে কেউ বাড়িতে রাখতে রাজি নয় আর। জানিয়ে দেওয়া হল, দ্রুত চলে যেতে হবে অন্য কোথাও— যেখানে খুশি। কিন্তু কোথায় যাবে মেয়েটি? এই শহরে তার চেনাজানাও তো কেউ নেই। করোনাভাইরাসের থাবা ততোক্ষণে ছোট্ট মেয়েটির শরীরে জুড়ে বসেছে। কোথায় যাবে অসুস্থ এই মেয়ে? লোকমুখে খবর পেয়ে একদল সাহসী তরুণ কিশোরীটিকে নিয়ে এলো নিজেদের আইসোলেশন সেন্টারে। পরম মমতায় সেখানে চললো তার চিকিৎসা। সেই মেয়ে একসময় করোনাকে হারিয়ে দিয়ে সুস্থও হয়ে উঠলো।

গত ২৮ জুনের একটি ঘটনা তুলে ধরলেন জিনাত সোহানা চৌধুরী। চাঁদপুর সদরেও পৌঁছে গিয়েছিল চট্টগ্রামের করোনা আইসোলেশন সেন্টারের নাম। ৬০ বছর বয়সী হাজী বজলু যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী, তার স্বজনরা চোখে দেখছেন অন্ধকার— তখন সেই চাঁদপুর সদর থেকেই অ্যাম্বুলেন্সে করে ছোট একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার সঙ্গে নিয়ে তারা রওনা হলেন চট্টগ্রামের পথে। কিন্তু আসতে আসতে পথেই শেষ হয়ে যায় অক্সিজেন। প্রায় নিঃসাড় হাজী বজলু যখন হালিশহরের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে এসে পৌঁছান, তখন তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল রীতিমতো ৮০! জীবন-মৃত্যুর শঙ্কা। আইসোলেশন সেন্টারের সামনে এসে দাঁড়াতেই সেই অ্যাম্বুলেন্সের পাশে স্বেচ্ছাসেবীরা দাঁড়িয়ে গেলেন দেবদূত হয়ে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাতে নামাতে দেরি হয়ে যাবে— এই আশঙ্কা থেকে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরেই তারা অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল দ্রুতগতিতে। ডাক্তাররা দিলেন জরুরি কিছু ওষুধ। ৪০ মিনিটের উৎকন্ঠা শেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হাজী বজলুর অক্সিজেন লেভেল উঠে যায় ৯২-তে। আইসোলেশন সেন্টারের স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকেরই চোখ তখন অশ্রুভেজা— বিজয়ের অশ্রু!

করোনাকালের দুঃসময়ে হাসি ফোটানোর এমন গল্প এক নয়, একাধিক। এতো সব গল্প— বলে শেষ করা যায় না। সেই গল্প বলার আগে পটভূমিটুকু বলা যাক।

করোনাকালে ভালোবাসার মায়া ছড়িয়ে যাচ্ছে একদল তরুণ 1

এগিয়ে আসার গল্প
চট্টগ্রাম করোনার প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি না নেওয়ার ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। তখন চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা রোগী তো দূরের কথা, সাধারণ শ্বাসকষ্টের রোগীকেও দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতো। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে পথেই মারা পড়তো অনেক রোগী। চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার এই যখন করুণ অবস্থা— তখন এগিয়ে আসেন একদল স্বপ্নবাজ তরুণ। মাত্র ১০ দিনের প্রচেষ্টায় তারা গড়ে তোলেন ১০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার। যা এক পর্যায়ে রূপ নেয় পরিপূর্ণ চিকিৎসা কেন্দ্রে।

স্বপ্নবাজ এই উদ্যমী যুবকেরা হলেন মোহাম্মদ সাজ্জাত হোসেন, এডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী, নুরুল আজিম রনি, গোলাম সামদানি জনি, তৌহিদুল ইসলাম, জাওইদ আলী চৌধুরী, আকরাম উল্লাহ, কামরুল হাসান চৌধুরী সুমন, নুরুজ্জামান, সাদ শাহরিয়ার, জাফর আল তানিয়ার, জাহাঙ্গীর আলম, এডভোকেট টি আর খাঁনসহ আরও কয়েকজন তরুণ। এদের কেউ বর্তমান ও সাবেক ছাত্রনেতা, কেউ আইনজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউবা শিক্ষক, কেউবা আবার রাজনীতিবিদ।

ছাত্র অবস্থা থেকেই মানুষের জন্য কাজ করা তাদের নেশা। করোনার ভয়ে সবাই যখন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে চার দেয়ালের মধ্যে, তখন তারা সাহস করে বেরিয়ে করোনা রোগীদের সেবায় গড়ে তুললেন আইসোলেশন সেন্টার। এরপর বাকিটা ইতিহাস। দিনরাত সেবা দিয়ে তারা সুস্থ করে তুললেন শত শত করোনা রোগী। সেবা দিতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ নিজেরাও আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। সুস্থ হয়ে আবারও নেমে পড়েছেন করোনা রোগীদের সেবায়।

করোনাকালে ভালোবাসার মায়া ছড়িয়ে যাচ্ছে একদল তরুণ 2

সাধ্য সীমিত, বুকে অদম্য সাহস
১২ জন ডাক্তার, ৭ জন নার্স ও ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরের কমিউনিটি সেন্টার প্রিন্স অব চিটাগংয়ে যাত্রা শুরু করে এই আইসোলেশন সেন্টার। এখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে শুক্রবার (২৯ আগস্ট) রাত পর্যন্ত বাড়ি ফিরেছেন ৫২৬ জন রোগী। যাদের অধিকাংশই করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) রোগী। তাদের খাওয়া, থাকা, চিকিৎসা ও ওষুধ সবকিছুই দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে।

অকুতোভয়ে যেসব চিকিৎসক দিনরাত করোনারোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ক্লান্তিহীনভাবে, তাদের মধ্যে রয়েছেন— ডা. আসাদুজ্জামান, ডা. সুদীপ্ত দত্ত, ডা. তৃষিতা দত্ত, ডা. কামরুল ইসলাম, ডা. মোহাম্মদ রাসেল, ডা. হাসিবুল হোসাইন, ডা. খন্দকার এনামুল নাইম, ডা. ফয়সাল ইবনে মামুন, ডা. রবিন শর্মা, ডা. সাদ্দাম হোসাইন মোল্লা, ডা. নাসরিনা পারভিন, ডা. রবিউল ইসলাম।

আইসোলেশন সেন্টারে নার্স হিসেবে কাজ করছেন আয়েশা আকতার নিপু, সাখাওয়াত হোসেন, দেলোয়ার হোসেন রাকিব, ইমরান হোসাইন, রাবেয়া আকতার, আরিফুল ইসলাম তৌহিদ, রাজিবা চৌধুরী, হাফসা চৌধুরী ও লিমা।

অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই ছাত্রলীগ কর্মী, কেউবা আবার কলেজছাত্র। এরা একেবারেই সেবা করার মানসিকতা নিয়ে সাহস করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সাহসী এই স্বেচ্ছাসেবকরা হলেন— মিজানুর রহমান, আরিফ উদ্দিন, শাহজাদা চৌধুরী, জামশেদ, শিবলী রহমান, তাজুল ইসলাম শিবলী, তৌহিদ ইসলাম, ইমান উদ্দিন আহমেদ, জালাল উদ্দিন জাহেদ, আহিশিক পাল জিতু, জিসান উদ্দিন, অমিত চক্রবর্তী, যুবরাজ, মোহাম্মদ শফিক, কাজী আবদুল আজিজ রায়ান, শিহাব আলী চৌধুরী, মুন্না বড়ুয়া, শাহাদাত হোসেন, মোহাম্মদ বেলাল, দেলোয়ার হোসেন রাকিব।

বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিপর্যায়ের অনুদানে পরিচালিত এই আইসোলেশন সেন্টারে বর্তমানে রয়েছে করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথ, এক্স-রে মেশিন, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলাসহ করোনা চিকিৎসার বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি।

করোনা আইসোলেশন সেন্টার চট্টগ্রামের প্রধান উদ্যোক্তা সাজ্জাত হোসেন, প্রধান সমন্বয়ক নুরুল আজিম রনি, মুখপাত্র এডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তোলার সামনের পিছনের সব গল্পই তুলে ধরেছেন চট্টগ্রামে প্রতিদিনের কাছে।

করোনাকালে ভালোবাসার মায়া ছড়িয়ে যাচ্ছে একদল তরুণ 3

শুরুটা যেভাবে
সাজ্জাত হোসেন বলেন, ‘গত রোজায় আমার ছোট ভাই করোনায় আক্রান্ত হল। সে চট্টগ্রামের পাঁচ তারকা হোটেল রেডিসন ব্লুতে কর্মরত। তার চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ছুটতে থাকি। কিন্তু কেউ ভর্তি নিচ্ছে না। পরবর্তীতে তার অফিস থেকে সিএসসিআর হাসপাতালে কল করলে তাকে ভর্তি নেয়। তখন আমার মাথায় এলো আমার ভাই বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে বলে ভর্তি হতে পারছে। কিন্তু পত্রপত্রিকায় যে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী ভর্তি না নেওয়ার খবর আসে, সামান্য অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে তাদের কী হবে?’

‘এসব বিষয় চিন্তা করে ঈদের আগের দিন আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিই। যার সারমর্ম হলো, আমি একটা আইসোলেশন সেন্টার করতে চাই। আমার সাথে কারা সারথী হতে চান? যারা সারথী হতে চান হাত তুলুন। এরপর আমি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন ভাইয়ের সাথে বিষয়টি শেয়ার করি। উনি বললেন এটা খুব ভালো উদ্যোগ। তুমি করো, আমি আমার জায়গা থেকে যতটুকু পারি সহযোগিতা করবো। এরপর এডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুম চৌধুরীও সমর্থন করলেন। তিনি কয়েকটা জায়গার কথাও বললেন। এরপর আমার সাথে অনেকেই যোগাযোগ করলেন। পরে আইসোলেশন সেন্টার কমিউনিটি হলে করবো বলে সিদ্ধান্ত নিই। এরপর আমরা সাতকানিয়ার আবু ভাইয়ের মালিকানাধীন প্রিন্স অব চিটাগং কমিউনিটি সেন্টারটি আইসোলেশন সেন্টারের জন্য নির্ধারণ করি। এই সব কিছু হলো ঈদের দুই-তিন দিনের মধ্যেই’— যোগ করেন সাজ্জাত হোসেন।

এলাকার লোক জ্বলে ওঠে তেলেবেগুনে
শুরুর দিকে বাধাও এসেছিল জানিয়ে সাজ্জাত হোসেন বলেন, ‘হালিশহর প্রিন্স অব চিটাগংয়ে আইসোলেশন সেন্টার হচ্ছে শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে স্থানীয়রা। কোনমতেই তারা এখানে আইসোলেশন সেন্টার করতে দেবে না। তারা কমিউনিটি হলের মালিক আবু ভাইয়ের সাথে রাগারাগি শুরু করেন। তখন তিনি বললেন আমার পক্ষ থেকে তো কোন বাধা নেই, কিন্তু স্থানীয়রা তো ঝামেলা করেতেছে। এরপর আমি তাদের সাথে কথা বললাম। তারা তাদের কথায় অনড়, এখানে কোন আইসোলেশন সেন্টার হতে দেবে না। পরে আমরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার, সিভিল সার্জন ছাড়াও ডিসি ফারুক সাহেবকে বিষয়টি জানালাম। পরবর্তীতে উনাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি সুরাহা হয়।’

করোনাকালে ভালোবাসার মায়া ছড়িয়ে যাচ্ছে একদল তরুণ 4

পাশে দাঁড়ালো হৃদয়বান তরুণরা
সাজ্জাত হোসেন বলেন, ‘স্থান নির্ধারণের পর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জাওইদ আলী চৌধুরী, প্রাক্তন ছাত্রনেতা আকরাম উল্লাহ, কামরুল হাসান চৌধুরী সুমন, নুরুজ্জামান, সাদ শাহরিয়ার, এডভোকেট টি আর খাঁনসহ আমার সাথে যারা থাকতে আগ্রহী বলে যোগাযোগ করছিলো তাদের নিয়ে একটা মিটিং করি। প্রথম দিকে ডাক্তার নার্স পাচ্ছিলাম না। পরে আমার চমেকের কিছু বন্ধুর মাধ্যমে ১২ জন জুনিয়র ডাক্তার ঠিক করলাম। এরপর তিনদিন পরে আরেকটা মিটিং আহ্বান করি। সেখানে যুক্ত হন নুরুল আজিম রনি, এডভোকেট জিনাত সোহানা ও মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সামদানি জনি ও তৌহিদুল ইসলাম। প্রথমে জিনাত সোহানা তিনটা বেড দিলেন। এরপর আমরা বসে কিছু পরিকল্পনা করলাম। আইসোলেশন সেন্টার চালু হওয়ার কিছুদিন পর আমরা ১৩ সদস্যের একটা পরিচালনা পর্ষদ গঠন করি। বর্তমানে এর মাধ্যমেই আইসোলেশন সেন্টারের সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে।’

প্রধান সমন্বয়ক নুরুল আজিম রনি বলেন, ‘সবকিছু ঠিকঠাক করার পর আমরা ১৩ জুন ১২ জন ডাক্তার, ৭ জন নার্স ও ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে আইসোলেশন সেন্টারের উদ্বোধন করি। এখানে যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যারা আছে, তারা সবাই ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। এরপর থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার করোনা ও করোনা উপসর্গের রোগী আসতে শুরু করে। আমরা বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসা, খাওয়া ও ওষুধ সরবরাহ করি। ধীরে ধীরে এটা চট্টগ্রামের করোনা রোগীদের আস্থার শীর্ষে চলে আসে।’

অনেক বিত্তশালী মহৎপ্রাণ মানুষের ঋণ স্বীকার করে সাজ্জাত হোসেন বলেন, ‘শিল্পপতি আবুল বশর আবু যদি তার কমিউনিটি সেন্টারটি না দিতেন, তাহলে আমাদের পক্ষে আইসোলেশন সেন্টার গড়া অনেক কঠিন হতো। অথচ তিনি এগিয়ে এসেছেন আন্তরিকভাবে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান আমাদের উপদেষ্টা হিসেবে সেই শুরু থেকে ছায়ার মতো পাশে আছেন। জিরি সুবেদার গ্রুপের কর্ণধার লোকমান হাকিম করোনা আইসোলেশন সেন্টারের জন্য প্রথম দিন থেকে প্রতিদিনই বিনামূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছেন। তাদের ঋণ শোধ করার নয়।’

অর্থ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের যোগান
একেবারেই ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা একটি আইসোলেশন সেন্টার কিভাবে চলছে— এমন প্রশ্নে আইসোলেশন সেন্টারটির মুখপাত্র জিনাত সোহানা বলেন, ‘একটি আইসোলেশন সেন্টার ধরতে গেলে একটা হাসপাতালের মতোই। এখানে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন ধরনের খরচ আছে। এসব খরচের যোগান দিতে কিছু ব্যক্তি আর কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। বলা যায়, এটি একটি অনুদাননির্ভর প্রতিষ্ঠান। আমাদের তিনজনের স্বাক্ষরে একটা ব্যাংক একাউন্ট আছে। সেখান থেকে ডাক্তার, নার্সদের বেতনসহ আনুষাঙ্গিক খরচ করা হয়।’

জিনাত সোহানা চৌধুরী বললেন, ‘করোনা আইসোলেশন সেন্টার আধুনিকায়ন করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছি। পরিবারকে পর্যন্ত সময় দিতে পারিনি। হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা থেকে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, পোর্টেবল এক্সরে থেকে স্যাম্পল কালেকশন বুথ, এয়ারকন্ডিশনার থেকে শুরু করে অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড়ের জন্য দিনরাত শ্রম দিতে দ্বিধা করিনি। ডাক্তার ও নার্সদের বেতন জোগাড় করেছি অনেক কষ্টে। বিশেষ করে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যারা কাজ করেছেন অসীম সাহস নিয়ে— তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। সেবা দিতে গিয়ে এদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। সুস্থ হওয়ার পর তারাই আবার সেবা দিতে এগিয়ে এসেছেন হাসিমুখে।’

সেই শুরু থেকেই করোনা আইসোলেশন সেন্টারের পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেক হৃদয়বান মানুষ। কেউ টাকা নিয়ে, কেউ খাবার নিয়ে, কেউবা পাশে দাঁড়িয়েছেন চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে। তবু রোগীদের সবকিছুই যেহেতু বিনামূল্যে দেওয়া হয়, সে কারণে প্রতিমাসে টানাটানি থেকেই যায়। চিকিৎসকদের বেতন, রোগীদের খাবার, ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম— আরও কতো কিছু।

আনন্দটাই তাদের পরম পাওয়া
প্রধান সমন্বয়ক নুরুল আজিম রনি বলেন, করোনার কারণে আমরা সমাজের কিছু মানুষরূপী অমানুষকে চিনতে পেরেছি। নগরীর রৌফাবাদে শিশু নিবাস কেন্দ্রে তিন বছর ধরে বসবাস করতেন স্বামীহারা নিঃসন্তান মমতাজ বেগম। ১৭ জুন তার করোনার নমুনা পরীক্ষায় ফলাফল পজিটিভ আসে। এরপর শিশু নিবাস কর্তৃপক্ষ তাকে আর সেখানে রাখতে রাজি হননি। পরে ১৮ জুন তাকে নিয়ে আসা হয় আমাদের আইসোলেশন সেন্টারে। সেখানে ডাক্তার-নার্সদের পরম মমতা ও সেবায় ১২ দিনের মাথায় মঙ্গলবার ৩০ জুন সুস্থ হয়ে আইসোলেশন সেন্টার ত্যাগ করেন তিনি। আইসোলেশন সেন্টার ত্যাগ করার সময় ওনার চোখেমুখে যে আনন্দ আমরা দেখেছি, সেটাই ছিল আমাদের পরম পাওয়া।’

আরেকটি ঘটনার কথাও জানালেন রনি— ‘হাটহাজারী উপজেলার মেখল থেকে আমাদের এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন ৫৫ বছর বয়সী রওশন জাহান বেগম। এর আগে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেও তিনি চিকিৎসা পাননি। পরে করোনা নিয়ে ২৩ জুন ভর্তি হন আমাদের আইসোলেশন সেন্টারে। ১৩ দিনের মাথায় ১ জুলাই সুস্থ হয়ে আইসোলেশন সেন্টার ত্যাগ করেন তিনি। যাওয়ার সময় তার ও তার ছেলেদের অভিব্যক্তি ছিল তাকিয়ে থাকার মতো। এরকম অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী আমরা।’

একসময় ইট-পাথর ভেঙে জীবন চালালেও বয়সের কারণে অন্তত তিন বছর ধরে বৃদ্ধা ওই নারী নগরীর রৌফাবাদে শিশু নিবাস কেন্দ্রে বসবাস করছিলেন। হঠাৎ তিনি করোনায় আক্রান্ত হলেন। শিশু নিবাস কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিল, তাকে আর নিবাসে রাখা যাবে না। কোথায় যাবে নিঃসন্তান এই বৃদ্ধা নারী? করোনা আক্রান্ত সেই নারীকে নিয়ে এসেছিল আইসোলেশন সেন্টারের স্বেচ্ছাসেবীরা। স্বামীহারা সেই বৃদ্ধা সুস্থ হওয়ার পর জানালেন— আইসোলেশন সেন্টার ছেড়ে যেতে তার মন চাইছে না।

এমন সব মায়া ছড়ানোর গল্প নিয়ে এগিয়ে চলে চট্টগ্রামের ছোট্ট একটি করোনা আইসোলেশন সেন্টার।

সেবা দিতে দিতে উদ্যোক্তাও করোনায়
প্রধান উদ্যোক্তা সাজ্জাত বলেন, ‘করোনা রোগীদের সংস্পর্শে এসে তাদের দেখাশোনা, সেবা ও খোঁজখবর নিতে গিয়ে আইসোলেশন সেন্টার চালু হওয়ার মাসখানেক পর ২১ জুলাই আমি করোনায় আক্রান্ত হই। একপর্যায়ে আমার অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায়। জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলাম ৯ দিন। পরবর্তীতে আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়ে আবারও রোগীদের সেবায় ফিরে এসেছি।’

সাজ্জাত হোসেন আরও বলেন, ‘এই দীর্ঘ পথচলা মোটেও সুখকর ছিল না। বেশ মসৃণ ও কন্টকাকীর্ণ ছিল। উদ্যোগ নেওয়ার প্রথম থেকেই অনেক বাধা-বিপত্তি এসেছে। অনেকে নিরুৎসাহিতও করেছেন। কারও কথায় কানে নিইনি। মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। বৈশ্বিক দুর্যোগে যদি মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারি, তবে আমরা আবার কিসের মানুষ?’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!