কম বয়সীরাই সড়কে মারা যাচ্ছেন বেশি, ৪৩% দুর্ঘটনা মোটরসাইকেলের

সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০ বছরের কম বয়সীরাই মারা যাচ্ছে বেশি। এদের বেশিরভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যে আর্থিক ক্ষতি হয় সেই টাকা দিয়ে কয়েকটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। কেবল চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। বছর শেষে এ ক্ষতি ৩৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এক হিসাবে, গত বছর করোনার কড়াকড়ির মধ্যেও ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে।

গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় যে আর্থিক ক্ষতি হয় সেই টাকা দিয়ে কয়েকটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২০ সালে করোনার মধ্যেও ক্ষতি হয়েছে ৩২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।’

পুলিশের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৯ সালে তিন হাজার ৯৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন চার হাজার ৩৫৮ জন। আহত হয়েছেন আট হাজার ২৪০ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে এবং ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হচ্ছে।

এদিকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে দেশে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ— ওভারটেকিং। গবেষকদের তথ্যমতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো ঘটে সচরাচর বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, ক্লান্তি নিয়ে চালানো, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বলার কারণে। মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয় পথচারীদেরও।

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশ। তবে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। যে হারে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে, দুর্ঘটনাও বাড়ছে সে হারেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন (নিসচা) জানিয়েছে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টিই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনের এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি ২০২১ সালের জুন মাসে সড়কে ১৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫২ জন নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৯৪ জন পথচারী এবং ৬৭ জন যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিলেন। ওই দুর্ঘটনার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছিলেন। পরে সেই আন্দোলন গণবিক্ষোভে রূপ নিয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে আইন সংশোধনের ঘোষণা আসার পর শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছেড়েছিলেন।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘মহাসড়কে দ্রুতগতিতে যানবাহন চলবে এটাই তো স্বাভাবিক। সেখানে মহাসড়কের মধ্যে হাটবাজার, ইজিবাইক, নছিমন, করিমন চলছে। আবার পথচারীরা হুট করেই দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। ফলে শুধু একপক্ষকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দরদ দিয়ে কাজটা করতে হবে। আমাদের দেশে পুলিশকে দেখলে কোনো ড্রাইভার ভয় পায় না। কারণ তারা জানে পুলিশকে ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু বহির্বিশ্বে দেখেন চালকরা অনেক বেশি স্বচ্ছল। তারা নিজের গাড়ি নিজেই চালান। সবাই আইন মেনে চলেন। কিন্তু তারপরও পুলিশ সারা বছর রাস্তায় কড়া দৃষ্টি রাখে। এখন একজন পুলিশকে দেখলে ড্রাইভারকে ভয় পেতে হবে। আমাদের পাশেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও সড়কে শৃঙ্খলা আছে। তারা আইন মেনে চলে। অথচ আমরা কেউই আইন মানছি না।’

তিনি বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের দায়িত্ব কি শুধু চালকের? আমরা কি কখনও খোঁজ নেই একজন চালক কত ঘণ্টা গাড়ি চালান? টানা ১২-১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালানো কি কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব? আমাদের দেশে গাড়ির সংখ্যা কত আর চালকের সংখ্যা কত? একজন শিক্ষার্থীকে মাস্টার্স পাস করাতে তার পেছনে বাবা-মা আর সরকার কত টাকা খরচ করে, খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? কিন্তু একজন চালক তৈরিতে সরকার এক টাকাও খরচ করে না। এদের পেছনে তো লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয় না। এদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলেই হয়। এমন অনেক কিছু আছে। তাই আমি বলব, এখানে কাউকে দোষারোপ না করে সবাইকে দায় নিতে হবে। সমন্বিতভাবে কাজ করলে অবশ্যই সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব।’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি তথ্যমতে, গত ছয় বছরে সারা দেশে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত এবং ৯১ হাজার ৩৫৮ জন আহত হয়েছেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সংঘটিত দুর্ঘটনায় হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ সালে ছয় হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় আট হাজার ৬৪২ জন নিহত, ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত; ২০১৬ সালে চার হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ৫৫ জন নিহত, ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত; ২০১৭ সালে চার হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৩৯৭ জন নিহত, ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত; ২০১৮ সালে পাঁচ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ২২১ জন নিহত, ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত; ২০১৯ সালে পাঁচ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৮৫৫ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছে।

এছাড়া ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে বছরব্যাপী লকডাউনে পরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় চার হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও আট হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!