কম দামে বিদেশি ঘড়ির টোপ— নিউমার্কেটে সক্রিয় প্রতারকচক্র

তারা অবস্থান নেয় নিউমার্কেট এলাকায়— বুঝেশুনে কাউকে টার্গেট করবে। প্রথমত, টার্গেট করা মানুষকে পরিচয় দেবে তারা বিদেশ ফেরত। দেশে এসে আর্থিক ঝামেলায় পড়ার কারণে বিদেশ থেকে আনা স্বর্ণের ঘড়ি বিক্রি করতে চায়। কৌশলে সাধারণ মানুষকে তারা এটা বোঝায় যে তারা আশেপাশের কিছুই চেনে না। এরপর তারা বলে তাদের যেনো বিক্রি করার স্থান দেখিয়ে দেয়। পরবর্তীতে নিজেই বলবে সেই মানুষটিকে এই ঘড়িটি তিনি কিনবেন কী না এবং কিনলে তার কাছে অল্পমূল্যেই বিক্রি করবে।

দ্বিতীয়ত, সেই দলের আর একজন হুট করে এসে নিজেকে ঘড়ির দোকানের মালিক পরিচয় দেবে, ঘড়িটি দেখে বলবে এই ঘড়িটি আসল এবং অনেক দামী যাতে সাধারণ মানুষ এই ঘড়ি কিনতে উদ্বুদ্ধ হয়। সাথে সাথে দ্বিতীয় প্রতারক (দোকানের মালিক দাবি করে) পকেট থেকে কয়েক হাজার টাকা বের করে ঘড়িটি কিনতে চাইবে। কিন্তু প্রথমজন দ্বিতীয়জনের কাছে বিক্রি করবে না। সে বোঝাতে চাইবে সে সাধারণ মানুষটাকেই (টার্গেট) বিশ্বাস করে।

তৃতীয়ধাপে আসবে ৩ নম্বর প্রতারক। সেই প্রথম প্রতারকের পাসপোর্ট দেখে এবং পুরো ঘটনা শোনার অভিনয় করে যাবে। এরপর সম্পূর্ণ ঘটনা শোনার পর সমঝোতা করে ঘড়িটি কেনার প্রস্তাব দেবে। তৃতীয় প্রতারক নাছোড়বান্দার মতো ঘড়িটি কেনার অভিনয় করেই যাবে। যাতে সাধারণ মানুষটির লোভ আরো বেড়ে যায়।

প্রতারকচক্রের এই অভিনব কায়দা যদি সাধারণ মানুষটি বুঝতে না পারে এবং লোভে পড়ে যায় তাহলে শেষমেশ সেই মানুষটি প্রতারক চক্রের দ্বারা প্রতারিত হয়। আর যারা বুঝতে পারে তারা এদের এড়িয়ে চলে যায়।

চট্টগ্রাম নগরীর নিউমার্কেট টু স্টেশন রোডে বিদেশি ঘড়ি বিক্রির কথা বলে এভাবেই প্রতারণা করে আসছিলো চক্রটি। এদের প্রতারণার কবলে পড়ে অনেক সাধারণ মানুষ ঠকেছেন।একদল প্রতারক চক্র ঘড়ি বিক্রির নামে নিউমার্কেট থেকে শুরু করে রেলস্টেশন পর্যন্ত স্থানে অবস্থান নেয় টার্গেট ধরতে।

ফেসবুকে এ ধরনের একটি স্ট্যাটাস দেখে পোস্টদাতা সাঈদ নাঈমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক ঠিক এমন একটি ঘটনা আরো একজনের সাথে ঘটেছে। সে এ বিষয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাস্টাস দেয়। স্ট্যাটাসটি দেখে আমার পাঁচমাস আগে সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে পড়ে যায়। আমি ওই পোস্টটিকে সংগৃহীত লিখে নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করি। এই চক্রটির লোকজনকে এখনো দেখা যায়। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের আসলে কিছু করার নেই।’

সাঈদ নাঈম বলেন ‘৫/৬ মাস পূর্বে সকাল ১০টার দিকে নিউমার্কেট গিয়েছিলাম ৪বন্ধু মিলে কিছু কেনাকাটা করার জন্য। তখন সব দোকানপাট তেমন খোলেনি। আমার হাঁটছিলাম নিউমার্কেটের সামনে যে বাটার শো-রুম আছে ওই রাস্তাটা দিয়ে। ওই বাটা শো-রুমের সামনে কিছু মানিব্যাগের ভ্রাম্যমাণ দোকান ছিলো। আমার দুই বন্ধু সেই মানিব্যাগের দোকানে মানিব্যাগ দেখছিলো। তখন ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যেতেই এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের সাথে কথা বলতে চাইলে আমরা সম্মতি দিই। তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে আমাদের বলেন, বাবা আমার বাড়ি চকরিয়া। চট্টগ্রাম মেডিকেলে আমার একটা আত্মীয় আছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। তাকে দেখতে আসার পথে গাড়ি থেকে পকেটমার আমার টাকা মোবাইল সবকিছু নিয়ে নিয়েছে। আর আমি এখানে থাকি না। বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে আসছি কয়েকদিন আগে। এখানকার তেমন কিছু চিনি না। তোমরা আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবে? তিনি বলেন আমাকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে হবে না। বিদেশ থেকে আনা আমার কাছে এই ঘড়িটা আছে শুধু, আর কিছুই নেই। তোমরা আমাকে এটা বিক্রি করার একটু ব্যবস্থা করে দাও। তার কথাগুলো খুব মনযোগ সহকারে শুনলাম। তারপর বললাম আমাদের তো এইখানে তেমন পরিচিত কেউ নেই। আশেপাশে তো নতুন ঘড়ির দোকান। মনে হয় আপনার এই পুরাতন ঘড়িটা কেউ কিনবে না। তখন তিনি বলেন, এই ঘড়িটাতে স্বর্ণের অংশ আছে। অনেক দামী ঘড়ি। এটা আমি বিদেশ থেকে কিনেছি ২০ হাজার টাকা দিয়ে। তোমরা নিলে কম দামে দিতে পারি। ৩ হাজার টাকা দিলে হবে। তখন আমরা তার কথায় খুশি হয়ে গেলাম। কারণ তার মার্কেটিং পলিসিটা দারুণ। খুশি না হওয়ার উপায় নেই। এর মধ্যে পাশের আরেকটি লোক ওই সিন্ডিকেটের পরে বুঝতে পারলাম। তিনি আমাদের সব কথায় মনযোগ দিয়ে শুনেছেন। তখন আমাদের ৪জনের মধ্যে ৩জনেই তার সেই দামী ঘড়ির লোভে পড়ে গেলাম। আমরা রীতিমতো মনস্থির করলাম ঘড়িটা আমরা নিয়ে নিবো।

তারপর তার সাথে চলছে আমাদের দর কষাকষি হলো এরমধ্যে পাশে থাকা লোকটি বলে উঠলেন— এটাতো দারুণ একটা ঘড়ি। আমি যখন বিদেশ ছিলাম তখন এই ঘড়িটা আমিও ব্যবহার করতাম। ভাই এটা কতো দিয়ে বিক্রি করবেন? আমি আপনাকে ৩ হাজার ৫শ টাকা দিবো। ঘড়িওয়ালা তখন তাকে বলে উঠলেন ভাই, ওদের সাথে কথাবার্তা হয়ে গেছে ওরা নেবে ঘড়িটা।একদিকে আমাদের কেনার ইচ্ছে আছে আবার ৩ হাজার টাকার ব্যাপার তাই ভয়ও লাগছিলো।

এরপর এক পর্যায়ে আমরা ঘড়িটা না কেনার জন্য উনাকে বললাম, ৫০০ টাকা দিয়ে দেবেন? তিনি বললেন, এই যে দেখো তোমাদের সামনেই তো ৩৫০০ টাকার কাস্টমার ছিলো।তখন পাশে থাকা ব্যক্তি ওই জায়গা থেকে আড়ালে চলে যান।এমন দর কষাকষি করতে করতে তিনি এক পর্যায়ে ৫০০ টাকাতেই রাজি হয়ে যায়।

পরবর্তীতে বললাম আমাদের টাকা নেই নিবো না। এই কথা বলতেই দেখি তার আচরণ মুহুর্তের মধ্যেই পরিবর্তন হয়ে গেলো।লোকটি আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করলেন।এর মধ্যে আমাদের কথা কাটাকাটি হচ্ছে, ওনি হুট করে বলে বসলেন— এই তোরা কে আছোস ওদের বাইন্দা রাখ, চট্রগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। পরবর্তীতে দোকানদানরা আমাদের রক্ষা করে তাদের হাত থেকে।

সাইদ নাইম আরো বলেন, ‘আমরা যতটুকু বুঝেছি, আসলে এই ব্যাপারটা যেহেতু কয়েকদিনের না, এটা অনেক বছর পুরনো সিস্টেম ওদের।সেহেতু আশেপাশের দোকানদাররা এই ব্যাপারে অবগত আছেন। আর এই সমস্যাটা কম বেশি চট্রগ্রামে যারা থাকেন, কিংবা যারা যায়গাটি দিয়ে নিয়মিত আসা যাওয়া করেন, তারা সবাই জানে।আর এর ভুক্তভুগীর সংখ্যাও কম নয়।’

স্থানীয় এবং দোকানদারদের সাথে এ বিষয়ে কথা বললে বিষয়টি স্বীকার করে তারা বলেন, ‘এটি নতুন কিছু নয়। ১৫ বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে ঘড়ি বিক্রির প্রতারক চক্রটি এই এলাকায় এসব করে যাচ্ছে। একেকদিন দিন তারা একেক জনকে টার্গেট করে। তবে মানুষ বুঝে টার্গেট করে। লুঙ্গি পরা, সহজ সরল সাধারণ কেউ, ট্রেন বা বাসে করে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত এসব মানুষকেই তারা টার্গেট করে। প্রথম প্রথম তারা এখানকার কাউকে টার্গেট করতো। বারবার ঠকার পর স্থানীয়রা সাবধান হয়ে গেছে। এটা অনেক বড় দল। এই দলে অনেক মানুষ আছে।৷ যখন একজনকে টার্গেট করবে তখন তার আশপাশে ৪/৫ জন হাঁটাহাঁটি করতে থাকবে। কখনো কখনো একদম সরল মনের কাউকে পেলে নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে গিয়েও লুট করার ঘটনাও ঘটে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোতায়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, আগে এমন অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করে তাদের আদালতে পাঠিয়েছি।তবে আমরা এসব ব্যাপারে সবসময়েই সতর্ক থাকি। নিউমার্কেট এলাকায় এখন এ ধরনের কাজ খুব কম হয়ে থাকে। এরপরও যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে এবং কেউ অভিযোগ করে তাহলে চক্রটিকেও আমরা কৌশলে ধরার চেষ্টা করবো।

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!