চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে যোগ দিতে গিয়ে অধ্যক্ষ জানলেন নিয়োগ স্থগিত ফোনে!

মন্ত্রণালয়ের একই কাণ্ড বাকলিয়া সরকারি কলেজেও

৩১ ডিসেম্বর বছরের শেষ দিনে চট্টগ্রামের সরকারি কমার্স কলেজে ঘটেছে এক নজিরবিহীন ঘটনা। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও চাকরির প্রবিধিমালা অনুসারে সরকারি কমার্স কলেজের নতুন অধ্যক্ষ কর্মস্থলে যোগদান করার পর জানানো হয় তাঁর ‘বদলি পদায়ন’ আদেশ স্থগিত। এদিকে এই আদেশ স্থগিত করা হয় তাও মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশনায়। অথচ ততক্ষণে প্রবিধি-ধারা ৪৭ পূরণ করা হয়ে গেছে। পদায়নের আদেশ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হলেও স্থগিত আদেশ জানানো হয় মৌখিকভাবে। এদিকে নিয়োগ ও পদায়ন আদেশ স্থগিত বা বাতিল কোনোটাই মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়নি। এই ঘটনা চট্টগ্রামের শিক্ষাঙ্গনে রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দেয়।

কমার্স কলেজেই শুধু নয়, এমন নজিরবিহীন কাণ্ড ঘটেছে বাকলিয়া সরকারি কলেজেও। সেখানেও একজন শিক্ষককে পদায়নের পর তড়িঘড়ি আবার সেই আদেশ প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয় মৌখিকভাবে।

জানা গেছে, গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অবসরোত্তরজনিত ছুটিতে যান সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সাগর কান্তি দে। নতুন অধ্যক্ষ হিসেবে গত ১৭ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে বাকলিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সিরাজ উদ্ দৌলাকে কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি করা হয় এবং ৩১ ডিসেম্বর নতুন কর্মস্থলে যোগদান করার আদেশও দেওয়া হয়। একইভাবে বাকলিয়া সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন করা হয় চট্টগ্রাম কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর জসিম উদ্দিন খানকে। যদিও দুজনের ক্ষেত্রে নিয়োগের আদেশ স্থগিত বা বাতিল কোনোটিই এখনও করেনি মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যান এবং নতুন অধ্যক্ষকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌস আরা বেগমকে হস্তান্তর করেন। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে ৩১ ডিসেম্বর সকালে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে আসেন বাকলিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সিরাজ উদ্ দৌলা। অধ্যক্ষের সকল দায়িত্ব বুঝে নিয়ে ধারা ৪৭ ফরমও পূরণ করেন। সকলের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্তও হন। কেবল স্মারক নম্বর দিয়ে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া বাকি ছিল। ঠিক এই সময়েই তাকে জানানো হয় ‘স্মারক নম্বর না দেয়ার জন্য কারণে এই পদে আপাতত তাকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। মন্ত্রণালয় নতুন সিদ্ধান্ত জানাবে।’

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, দুই শিক্ষককেই মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশনা ব্যাপারে অবহিত করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাবোর্ডের (মাউশি) পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী। তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কোনোরকম সাড়া পাওয়া যায়নি।

মাউশির পরিচালককে যোগদানের বিষয়ে জানানো হলে সেখান থেকে জানানো হয় মন্ত্রণালয় নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবে। এমন ঘটনার পর অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সিরাজ উদ্ দৌলা কর্মস্থলেই ধারা ৪৭-এর ফরম ছিঁড়ে ফেলেন।

এদিকে মন্ত্রণালয়ের এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অপমানজনক কর্মকাণ্ডে হতবাক হয়েছেন অনেকেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন শিক্ষক জানান, যদি তিনি এই পদে যোগ্য না হতেন তাহলে আরও আগেই আদেশ বা নোটিশ দিয়ে জানাতে পারতেন। যোগদান করার পর এভাবে নিষেধ করা একজন প্রবীণ শিক্ষকের জন্য রীতিমতো অপমান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমন নজিরবিহীন কাণ্ড একজন শিক্ষকের জন্য, একজন কর্মকর্তার জন্য অসম্মানজনক। ১৭ ডিসেম্বর আদেশ হওয়ার পর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যথেষ্ট সময় ছিল এই আদেশ বাতিল করার। মন্ত্রণালয় আদেশ বাতিল করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার শতভাগ রাখে। যদি এর আগে জানাতেন তাহলে উনি সেখানে জয়েন করতেন না। এখন সবকিছু করার পর জানালেন এখন আর হবে না পরে জানানো হবে। এটা কেমন ছেলেমানুষি কাজ একজন প্রবীণ শিক্ষকের সাথে?’

ওই শিক্ষক আরও বলেন, ‘একটা অর্ডার যখন করা হয় যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করেই করা হয়। সেখানে যদি উনি যোগ্য না হতেন তাহলে অর্ডার না করতো। যাচাই-বাছাই করে অভিযোগ পাওয়া গেলে না দিতো। অর্ডার করে আবার কেড়ে নেওয়া খুবই অপমানজনক।’

জানা যায়, কমার্স কলেজে বিশেষায়িত কলেজ হওয়ায় অনেকেই এই পদের প্রার্থী ছিলেন। যারা প্রার্থী ছিলেন, তারা বিভিন্নভাবে তদবির চালান যাতে এই নিয়োগ যে কোনোভাবে স্থগিত করা যায়।

জানা গেছে, বাকলিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সিরাজ উদ্ দৌলা নবমতম বিসিএস। ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক হয়ে সরকারি সিটি কলেজে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। প্রায় ২০ বছর সিটি কলেজে প্রভাষক হয়ে পদোন্নতি পেয়ে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সেখান থেকে বাকলিয়া সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পান। আরও জানা যায়, তিনি দশ মাস পরে অবসরোত্তর ছুটিতে যাবেন।

এক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘স্বাধীনতা বিসিএস শিক্ষা সংসদের নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে বিএনপি-জামাতপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সেই সংগঠনের এক সদস্য হুমকিও দেন প্রকাশ্যে— ‘বেশি তদবির-টদবির করতে মানা করো। তদবির করলে এমন জায়গায় পাঠাবো যে আর ফেরত আসতে হবে না।’

ওই শিক্ষক বলেন, ‘আমার স্বার্থে বিঘ্ন ঘটালে আমি বলবো জামাত। আবার আমার স্বার্থে বিঘ্ন ঘটালে আবার বলবো বিএনপি। এখানে আমি কে? আমি কোন বঙ্গবন্ধুর সৈনিক? কবে থেকে সৈনিক? মুখে হাজারবার বঙ্গবন্ধুর নাম— কেবল স্বার্থ হাসিলের জন্য। কিছু অসৎ লোক বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে সব অনিয়ম করে বেড়াচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা জাতির জনককেই অপমান করছে।’

এ প্রসঙ্গে বাকলিয়া কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সিরাজ উদ দৌলা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে মৌখিকভাবে বলেছে যোগদান না করার জন্য। মন্ত্রণালয় থেকে যা সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে তাই হবে। এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।’

একই প্রসঙ্গে সরকারি কমার্স কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌস আরা বেগম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। আর কী বলবো এটাই তো বিষয়। উনি জয়েন করতে এসেছেন উনারা (মন্ত্রণালয়) আপাতত পোস্টপন্ড (স্থগিত) রেখেছেন। এখন এগুলো আমার কাছ থেকে বলাটা বিব্রতকর। আমি আসলে এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।’

অন্যদিকে বাকলিয়া সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পাওয়া চট্টগ্রাম কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর জসিম উদ্দিন খানও কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করতে পারে। যেহেতু মন্ত্রণালয় আমাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। তারা যে কোনো আদেশ দিতে পারেন আবার চেঞ্জ করতেও পারেন। তবে এক্ষেত্রে কোনো আদেশ দেওয়া হয়নি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!