কমান্ডারের রোষে অপবাদ নিয়ে চলে গেলেন সাতকানিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা

একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর তাঁকে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র অপবাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বঞ্চিত করেছে প্রশাসন। পরে প্রণব কুমার ধর প্রকাশ পি কে ধর (৭০) নামের ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ছাড়াই দাহ করেছে তাঁর স্বজনরা। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি চরম অবমাননাকর এই ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ইউনিয়নের তুলাতলী গ্রামে। সাতকানিয়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আবু তাহেরের ব্যক্তিগত আক্রোশে পি কে ধরকে এমন অবমাননার শিকার হতে হয়েছে বলে দাবি করছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে পিকে ধরের সাথে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা সহযোদ্ধারা।

জানা গেছে, রোববার (১৩ জানুয়ারি) রাতে মুক্তিযোদ্ধা প্রণব কুমার ধর নিজ বাড়িতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে রাত ১টার দিকে পটিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। পরে মৃত্যুর বিষয়টি সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন, সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিউল কবীর ও সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এলএমজিকে জানান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট প্রদীপ।

প্রশাসনের পরামর্শে পর দিন সোমবার দুপুর ১টায় পিকে ধরের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পরে প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়, ‘পিকে ধর একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হবে না।’ শেষে রাষ্ট্রীয় সম্মান ছাড়াই দাহ করে পরিবারের সদস্যরা।

প্রণব কুমার ধর গত ১৬ ডিসেম্বরও সাতকানিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। যেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এবং উপজেলা চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন।
প্রণব কুমার ধর গত ১৬ ডিসেম্বরও সাতকানিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। যেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এবং উপজেলা চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে গেজেটে ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম থাকা, সাতকানিয়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ভোটার হওয়ার পরেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সুবিধাভোগী না হওয়ার অজুহাতে পিকে ধরকে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সাতকানিয়া উপজেলা প্রশাসন। স্থানীয়দের অভিযোগ, সাতকানিয়ার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এসবের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। আবু তাহেরের বিরোধিতার কথা স্বীকার করে নিচ্ছে উপজেলা প্রশাসনও।

এ বিষয়ে সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিউল কবীর বলেন, ‘আমি আমার টিম নিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। শেষ মুহূর্তে উপজেলা কমান্ডার আবু তাহের এলএমজি আমাকে জানান তিনি (প্রণব) একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে আমি ইউএনওর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন প্রণব কুমার ধর সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে আর্থিক কোনো সুবিধা পান না। বিষয়টা নিয়ে ঝামেলা আছে।’

সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট প্রদীপ বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। পুলিশ প্রশাসন আসার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওসিকে ফোন দিয়ে জানান প্রণব একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা দেওয়া যায় না।’

সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, ‘প্রণব ধর প্রকাশ পি কে ধর তিনি (প্রণব) নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত নন। তবে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এলএমজি ফোন করে জানিয়েছেন তিনি (প্রণব ধর) ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।’

তবে পিকে ধর একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে দাবি করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। এমনকি রণাঙ্গনে একসাথে যুদ্ধ করেছেন বলেও জানিয়েছেন একই এলাকার আরেক সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তারা জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতার বিষয়ে কমিশন চাওয়াকে কেন্দ্র করে আবু তাহেরের সাথে দ্বন্দ্ব ছিল পিকে ধরের। পিকে ধরের সব কাগজপত্র ঠিক ছিল, এমনকি তিনি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাওয়াত পেতেন। আবু তাহের নিজেও বিভিন্ন সময়ে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাওয়াত দিয়েছেন। অনেক অনুষ্ঠানে সম্মাননা ও উপহারও তুলে দিয়েছেন। তবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতেন না। এই ভাতা পাইয়ে দিতে আবু তাহের পিকে ধরের কাছ থেকে টাকা দাবি করেছিলেন। টাকা দেয়ার সামর্থ্য থাকলেও কমিশন দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার বিষয়ে চরম অনাগ্রহ ছিল পিকে ধরের। এই বিষয়টি নিয়েই মূলত পিকে ধরের উপর ক্ষোভ ছিল আবু তাহেরের। এই ক্ষোভের জায়গা থেকেই পিকে ধরে লাশকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনকে বাধা দেন আবু তাহের এবং পিকে ধরকে একজন ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করেন। পরে আবু তাহেরের বক্তব্য আমলে নিয়ে পিকে ধরের লাশের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর অনুষ্ঠান স্থগিত করে উপজেলা প্রশাসন।

সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রমিজ উদ্দীন বলেন, ‘প্রণব একজন প্রকৃত গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা। আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি। মৃত্যুর দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। খবর পেয়ে সদ্য সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহেরকে অবহিত করেছি যাতে তিনি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তবে জীবিত অবস্থায় এলএমজি তাহের তাঁর কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়েছিল ওটা না দেওয়াতে তার লাশের সঙ্গে তাহের এটা করেছে বলেও জানান এ সাবেক কমান্ডার।’

এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাহজাহান বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা প্রণব কুমার ধরের মৃত্যুর খবর পেয়ে ওসি সাহেবকে জানিয়েছি। তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহেরের আপত্তি আছে বলে জানিয়েছেন। সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে ইউএনওরা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন। তাহলে কেন স্থানীয় প্রশাসন গেজেটে নাম থাকা সত্ত্বেও সাবেক কমান্ডারের বক্তব্যে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।’

একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি এমন অবমাননাকর আচরণে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে স্থানীয়রা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সবখানেই এই বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন অনেকে। তাদের দাবি এই ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে এবং পিকে ধরের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে তাঁর সুষ্ঠু সমাধান দিতে হবে।

উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক এমএ আজিজ বলেন, ‘প্রণব ধর একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনে তিনি ভোট দিয়ে আবু তাহের এলএমজিকে কমান্ডার বানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহেরও নিজে সাক্ষর করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দাওয়াতনামা দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি এমন কেন করলেন এটা রহস্যজনক। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’

উল্লেখ্য, প্রণব কুমার ধর গত ১৬ ডিসেম্বরও সাতকানিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। যেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের এবং উপজেলা চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন।

এএইচ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!