কঠোর না শিথিল— করোনা দমনে কেমন হওয়া উচিত ‘লকডাউন’?

করোনাভাইরাসের থাবায় পুরো বিশ্ব এখন ঘরবন্দি। অর্থনৈতিক ক্ষতি সত্ত্বেও মানুষকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে কয়েকটি ছাড়া প্রায় সবগুলো দেশে চলছে কঠোর লকডাউন। মানুষের জীবনচাকা থেমে আছে। তবু আশাবাদি হয়ে আমরা অপেক্ষায় আছি ভ্যাকসিনের জন্য, অপেক্ষায় আছি ঠিক কোন ওষুধ এটির প্রতিষেধক হবে এবং অপেক্ষা করি হার্ড ইমিউনিটির (স্থায়ী প্রতিরোধী ক্ষমতা) জন্য। তবু দুঃখজনক সত্যি এটাই— বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। এটির কোন প্রতিষেধকও এখনও পাওয়া যায়নি। সুরক্ষা ব্যবস্থা কর্যকর করে কিছু দেশ আংশিকভাবে লকডাউন তুলে নিতে শুরু করেছে। আবার কিছু দেশ গণহারে লকডাউন জারি করছে। কোথাও কোথাও লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রশ্ন এটাই যে, লকডাউন পুরোপুরি তুলে নিলে বা শিথিল করলে কী হতে পারে?

কয়েকটি দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল। তার কারণ হল পূর্ব প্রস্তুতি, লকডাউনে কঠোরতা, সংক্রমিতদের গতিবিধির উপর নজর রাখা এবং বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা। করোনা সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও মৃত্যু সংখ্যা বাড়তে দেয়নি দেশগুলো।

বিস্তৃত লকডাউন
একটি দেশকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নকরণ ও বসবাসকারীদের গণকোয়ারেন্টাইন বা নির্জনবাসে আইনিভাবে বাধ্য করা হয়। শারীরিক যোগাযোগকে বন্ধ করতে সব ধরনের চলাচলকে নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সময়টিতেই আক্রান্তদের শনাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আক্রান্ত বা নতুন করে সংক্রমিতদের মাধ্যমে রোগটির দ্রুত বিস্তারকে রোধ করতেই এই কঠোর লকডাউন নীতি। ভারত, চীন, ফ্রান্স, ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য বিশ্বের বৃহত্তম ও গণ কোয়ারেন্টাইন কার্যকর করতে সবচেয়ে কঠোরভাবে লকডাউন প্রয়োগ করেছে।

সংক্রমণের সংখ্যা কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এমন লকডাউনকে আরও দীর্ঘায়িত করার কথা ভাবছে। লকডাউনের সময়সীমা আরও ২ সপ্তাহ বাড়িয়েছে পাকিস্তান ও ভারত। বিবিসির তথ্যমতে, ইতালির প্রধানমন্ত্রী এই গণ কোয়ারেনটাইনের নাম দিয়েছেন— ‘আমি ঘরে থাকি’।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মতে, করোনায় প্রতিদিন ২০ শতাংশ করে মৃত্যু বেড়েছিল স্পেনে। করোনায় প্রায় ২৫ হাজার ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে স্পেনে। অথচ ইউরোপের মধ্যে স্পেন সবচেয়ে কড়া লকডাউন নীতি প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছে। খাদ্য, ওষুধ কেনা ও শিশুদের একঘণ্টা খোলা বাতাস পেতে বের হওয়ার অনুমতি ছাড়া সবকিছু বন্ধ ছিল। প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরচর্চা করতেও নির্দেশনা দেয় দেশটি। এখন সেখানে মৃত্যুসংখ্যা কমে প্রায় শূন্যে পৌঁছেছে। এখন সেখানে গুরুতর অবস্থায় আছে কেবল ৩ শতাংশ রোগী। এমন অবস্থায় শীঘ্রই তারা লকডাউন শিথিল করার পরিকল্পনা করছে।

সুইজারল্যান্ডে ২৬ হাজার ব্যক্তির মধ্যে করোনা শনাক্ত এবং ১২ শতাধিক মৃত্যু নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে নিজেকে সবচেয়ে অনিরাপদ হিসেবে আবিষ্কার করে। বর্তমান মহামারীর এ অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা বিশ্বের অন্যতম দক্ষ দেশ হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেশটি কঠোরতম লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মার্চের প্রথম দিন থেকে লকডাউন চলছে দেশটিতে। এখন লকডাউন শিথিল করার চিন্তা করছে সুইসরাও।

৫ সপ্তাহের কঠোর লকডাউনের পর নিউজিল্যান্ড ভাইরাসটিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে বলে দাবি করছে। দেশটিতে এক হাজার ৪৭৯ জন আক্রান্ত হয়েছিল এবং তার মধ্যে কেবল ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। দেশটির অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাইক্রোবায়োলজিস্ট সিয়ক্সসি ওয়াইলস একটি কলামে বলেছেন, ‘যদি জনসাধারণ লকডাউন না মানে বা দ্রুত শিথিল করা হয় তবে ভাইরাসটি ফিরে আসতে পারে। আমরা যদি এক মিনিটের জন্য আমাদের মুখ ফিরিয়ে নিই, তবে আবারও মারাত্মক প্রকোপের পথে যাব।’

আংশিক লকডাউন
এক্ষেত্রে পুরোপুরি লকডাউন না করে কেবল নির্দিষ্ট সংক্রমিত এলাকাকে অসংক্রমিত এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। লকডাউনের নিয়মকানুন কেবল ওই স্থানের জন্য প্রযোজ্য হয়। দেশের অন্য স্থানে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকে। তবে যথেষ্ট প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকলেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন ভাইরোলজিস্টরা।

সঠিক নিয়মে আংশিক লকডাউন পরিচালনার অনন্য উদাহরণ হলো দক্ষিণ কোরিয়া। ২০১৫ সালে মার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের অভিজ্ঞতার কারণে তাদের প্রস্তুতি ছিল সবচেয়ে ভাল। চীনে কোভিড-১৯ এর প্রকোপ শুরু হওয়া মাত্র তারা আরও সতর্ক অবস্থানে চলে যায়। কোভিড আক্রমণের একেবারেই শুরুর দিকেই তারা এয়ারপোর্টসহ দেশে প্রবেশের স্থানগুলোতে কড়াকড়ি আরোপ করে। একই সময় তারা পুরো দেশ লকডাউন করার পরিবর্তে নাগরিকদের কেনাকাটা ও জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসে। এছাড়াও সামাজিক দূরত্ব, প্রতিরোধ ও সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। দেশটিতে কোয়ারেন্টাইন পর্বেই বেশি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। প্রচুর নমুনা পরীক্ষা ও সংক্রমিতদের গতিবিধিতে নজরদারিকে (কন্টাক্ট ট্রেসিং) বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে প্রতি ১৪৭ জনের মধ্যে একজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে এবং সেখানে মোট মৃত্যু হয়েছে কেবল ২৪৮ জনের। পুরো দেশ একসাথে লকডাউন না করেই এখন তারা মৃত্যুহারকে প্রায় শূন্যে নিয়ে এসেছে।

শিথিল লকডাউন
এক্ষেত্রে লকডাউনের নিয়মনীতিতে কঠোরতা থাকে না। সংক্রমিতদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ওপর নজরদারি করা হয়, যাতে তারা রোগটি না ছড়াতে পারে। এ সময় সবাইকে স্বাস্থ্যনীতি মানতে হয়। জনসমাগম, উৎসব পালন ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রেখে কেবল দৈনন্দিন কাজকে স্বাভাবিক করা হয়। নিয়মতান্ত্রিক কঠোর লকডাউনের পর সংক্রমিতদের সংখ্যা কমলেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

প্রায় ২ মাসের কঠোরতার পর কিছু দেশে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। চীন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, ইতালির লম্বারডি ছাড়া অন্য এলাকা এবং ডেনমার্ক লকডাউন শিথিল করে। শুরুতে তারা কয়েকটি স্টেশনারি দোকান, গ্রোসারি দোকানসহ কিছু কোম্পানি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছে।

শিথিল লকডাউন নিয়ে কী বলছেন ভাইরোলজিস্টরা?
কয়েকজন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন, করোনাভাইরাস শনাক্তের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাবে ও মৃত্যু সংখ্যা শীর্ষে যেতে পারে যদি বর্তমান সামাজিক দূরত্বের ব্যবস্থা শিথিল করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইরোলজিস্ট ডা. জোসেফ ফেয়ার বলেছেন, ‘ভ্যাকসিনের ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। এটি দ্রুত তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও কম। নতুন শনাক্ত হওয়া গ্রাফরেখা হ্রাস না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব নীতি স্থির থাকা উচিত।’

বৃহস্পতিবার (৩০ এপ্রিল) এনবিসির টুডেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ফেয়ার বলেন, ‘পুনরায় সবকিছু খোলার বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে সাবধান হতে বলছি। কারণ মৃত্যু অবস্থা ও আক্রান্ত সংখ্যা শীর্ষে অবস্থান করছে দেশটি।’

ওই সাক্ষাৎকারে সামাজিক দূরত্ব কত দিন স্থায়ী থাকা উচিত জানতে চাইলে ড. ফেয়ার বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের কমপক্ষে ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

তিনি মনে করেন, প্রচুর টেস্ট ও রোগের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করার আগে লকডাউন শিথিল করা উচিত হবে না।

চীনের মহামারি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ভয় এখনও কাটেনি। সতর্কতাবিহীন লকডাউন শিথিল করলে ফিরে আসতে পারে ভাইরাসটি।

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারী বিশেষজ্ঞ বেন কাউলিং বলেন, লকডাউনে থেকেই পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এছাড়াও কাজের জন্য লকডাউনকে শিথিল করা হলেও নাগরিকের চলাচলের উপর কঠোর নজরদারি রাখা প্রয়োজন। কারণ ৭০ শতাংশ সুস্থ হওয়া মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি অর্জন করেছে কেবল ১০ শতাংশ। অন্যরা আবারও আক্রান্ত হতে পারে। টেস্টের সংখ্যা বাড়ালেই শিথিল লকডাউনে করোনার গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

কিছু গবেষক বলেছেন, চীনের পরিস্থিতি অন্যরকম। কারণ চীন সরকার ভাইরাস দমনে আগ্রাসীভাবে কাজ করেছিল। সম্ভাব্য সংক্রমণ রোধে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও কড়া লকডাউন নীতি অনুসরণ করেছে। তবে ইতালি এবং স্পেনসহ অন্য দেশগুলো নিবিড় পরীক্ষা ও কন্টাক্ট ট্রেসিং ছাড়াই শুধু সামাজিক দূরত্বের মাধ্যমে ভাইরাসের গতিকে ধীর করতে চেয়েছে। জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় তারা হয়তো আবারও করোনার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন।

লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া আগে যেসব বিষয় নিয়ন্ত্রণে আসতে হবে—
১. যত বেশি সম্ভব শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে।
২. শনাক্ত হওয়া রোগী সংখ্যা ও মৃত্যুহারের গ্রাফরেখাকে নামিয়ে আনতে হবে।
২. শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের কন্টাক্ট ট্রেসিং (তাদের যোগাযোগে নজরদারি)।
৩. দক্ষিণ কোরিয়া বেশি টেস্টের জন্য জনগণকে ভাইরাস সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়ে সচেতন করেছে। স্বাস্থ্য বিষয়ক নির্দেশনা অনুসরণ করতে উৎসাহী করেছিল।
৪. গণকোয়ারেন্টাইনকে শিথিল করলেও ব্যাপক জনসমাবেশ রোধ, উৎসব নিষিদ্ধকরণসহ চালিয়ে যেতে হবে সামাজিক দূরত্বের চর্চাও।
৫. কিছু দেশে রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতি পেয়েছে যদি সেটি বদ্ধ ঘরে না হয়ে বাইরে হয়। হাসপাতাল, ফার্মেসি প্রোডাক্ট, যে কোন কাজ বদ্ধ স্থানের পরিবর্তে ওপেন এয়ারে করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
৬. বিশেষভাবে অরক্ষিত মানুষকে (বৃদ্ধ ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত) সুরক্ষিত রাখা।
৬. সাউথ কোরিয়ায় সড়কে আঁকা হয়েছে ‘জিগজ্যাগ রো’— যাতে পথচারীরা পরস্পরের মুখোমুখি না হন।
৫. ব্যক্তিগত সুরক্ষায় মাস্ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লকডাউন শিথিল করা দেশগুলো মাস্ক পরাকে তাদের গাইডলাইনে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!