কক্সবাজারের মেয়ে রিমু যেভাবে বিশ্বসেরা ১০০ নারীর একজন

যে তালিকায় আছেন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কিংবা হলিউডের অভিনেত্রী মিশেল ইয়ো, যে তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারক সারা গিলবার্ট কিংবা আরব আমিরাতের মন্ত্রী সারাহ আল আমিরী বা পাকিস্তানি অভিনেত্রী মাহিরা খান— ১০০ জনের সেই নাতিদীর্ঘ তালিকায় সগৌরবে স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশেরও দুজন। এদের একজন কক্সবাজারের তরুণী রিমা সুলতানা রিমু এবং অন্যজন একসময়কার যৌনকর্মী রিনা আক্তার।

করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে যেসব নারী তাদের কাজ ও উদ্যোগ দিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন, অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী সেসব নারীকে নিয়ে ২০২০ সালের এই তালিকা তৈরি করেছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি। চলতি বছর বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন এই ১০০ নারী।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ানোর কাজ করেন রিমা সুলতানা রিমু। ১৮ বছরের এই তরুণী শিক্ষিকা কক্সবাজার অঞ্চলে আগে থেকেই পরিচিত মুখ। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় ইয়াং ওম্যান লিডার্স ফর পিস প্রোগ্রামের সদস্য তিনি। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অফ উইমেন পিসবিল্ডার্স-এর অংশ এই সংগঠনটি বিশ্বের সংঘর্ষপীড়িত অঞ্চলগুলোতে নারীদের নেতৃত্বের কাতারে নিয়ে আসতে কাজ করে।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ানোর কাজ করেন রিমা সুলতানা রিমু।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ানোর কাজ করেন রিমা সুলতানা রিমু।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে লিঙ্গ সমতা আনতে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন রিমু। লিঙ্গ সমতা সম্পর্কে বয়স-উপযোগী করে ক্লাসের আয়োজন করেছেন তিনি। বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সেইসব নারী ও মেয়েদের জন্য তিনি কাজ করেন— যারা কখনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায়নি।

এছাড়াও নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জাতিসংঘের নীতিমালাগুলো সম্পর্কে তার জনগোষ্ঠীর মানুষদের জানাতে কাজ করেছেন তিনি।

কক্সবাজারের মেয়ে রিমা সুলতানা রিমু বলেন, ‘বাংলাদেশে লিঙ্গ সমতা আনতে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি বিশ্বাস করি নারীরা তাদের লড়াই নিজেরাই করতে পারবে। আমাদের সাফল্য আসবেই।’

রিমু বলেন, ‘যখন আমি আমার চারপাশে তাকাই, আমি দেখি যে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নারীদের পুরুষদের চেয়ে কম বিবেচনা করা হয়। তাদের একই অধিকার এবং সুযোগ দেওয়া হয় না। অথচ তাদের সংস্কৃতি খুবই ঐতিহ্যবাহী। তারা দ্বন্দ্ব, সহিংসতা এবং বাস্তুচ্যুত হওয়ার মতো দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেছে। প্রতিদিন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মেয়েরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়— বাল্যবিবাহ, রাস্তায় হয়রানি এবং যৌন নির্যাতন। আমি সবসময়ই মনে হয়েছে, শরণার্থী নারীদের জীবনকে সহজ করার চেষ্টা করা এবং তাদের জন্য সমান সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করা আমার কর্তব্য।’

চলতি বছরের সেরা ১০০ নারীর তালিকায় থাকা এই তরুণী বলেন, ‘যখন আমি নারী অধিকার নিয়ে কথা বলতে শুরু করি, আমার পরিবারের কিছু সদস্য এটা পছন্দ করেনি। তারা বলেছে যে আমি আমার ধর্মকে অসম্মান করছি এবং সঠিক আচরণ করছি না। অন্য অনেকেও খুব হতাশাজনক আচরণ শুরু করেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, আমি ছিলাম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ— যা আমাকে আমার কাজ চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে।’

কক্সবাজারের মেয়ে রিমু যেভাবে বিশ্বসেরা ১০০ নারীর একজন 1

রিমা সুলতানা রিমু বলেন, ‘বেশিরভাগ রোহিঙ্গা নারী পড়তে বা লিখতে পারে না, তাই তারা তাদের অধিকার বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে পারে না। তাদের অনেকে খুব অল্প বয়সে স্কুল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এর ফলে কখনও যদি হয়রানি বা সহিংসতার মুখোমুখি হয়, তখনও তারা হয়ত অনুভব করবে না যে এটা অন্যায় এবং এর ন্যায়বিচার চাওয়া যায়।’

রিমু বলেন, ‘আমি এই কাজ ভালবাসি। আমার নিজের জন্যও বড় পরিকল্পনা আছে। আমি ইতিহাস পড়তে চাই। কবিতার বই লিখতে চাই। হয়তো একদিন আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও হব। কেন নয়? আমি থামবো না, যতক্ষণ না প্রত্যেক নারী এবং মেয়ে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সমানভাবে সুখী ও নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারে।’

বাংলাদেশ থেকে এবার বিবিসির সেরা ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন সাবেক এক যৌনকর্মী রিনা আক্তার। করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশের ঢাকায় যৌনপল্লীগুলোতে অবস্থিত নারী যৌনকর্মীরা ছিলেন অনাহারে। রোজগার বন্ধ ছিল। আবার সমাজের তথাকথিত ‘অন্ধকার’ জগতের বাসিন্দা হওয়ায় আড়ালে থেকে গিয়েছিলেন এই যৌনকর্মীরা। আর এই সময় তাদের জন্য এগিয়ে আসেন রিনা আক্তার। ভাত, সবজি, মাংস দিয়ে এক সপ্তাহে প্রায় ৪০০ যৌনকর্মীকে খাবার দিয়েছেন এই নারী।

রিনা আক্তার বলেন, ‘মানুষ আমাদের নিচু মনে করে, খারাপ মনে করে। কিন্তু আমরা শুধুমাত্র খাবারের জন্য এই কাজ করি। এই মহামারিতে এই নারীরা যেন অনাহারে না থাকে আমি শুধু সেই চেষ্টাই করছি। আমি চাই এই নারীদের সন্তানদের যেন এই পেশায় আসতে না হয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!