ওদের ভাঙা ঘরে জিপিএর সোনার আলো

‘আমি এ গ্রেড পেয়েছি, আমি ৪.৮৩ পেয়েছি’— চোখেমুখে লেপ্টে আছে হাসি। পুষ্পা সামনে এগিয়ে আসতেই ঝাপটে ধরে তাছিম এ কথা বললো। জিপিএ ৫ না পেলেও খুশির অন্ত নেই তার। সামনে যাকে পায় তাকেই জড়িয়ে ধরে বলছে অভিব্যক্তির কথা। তাছিমের মতো বাকিরাও আনন্দে আত্মহারা। একে অন্যকে নিয়ে করছে মাতামাতি। এই তাছিমদের খুশিতে বিভোর থাকার গল্পটা ভিন্ন। তবুও থেমে নেই স্বপ্ন।

প্রায়ই দিনে উপোস করে কাটাতে হয় তাছিমের। দুই ভাইবোনের দু বেলা দুই মুঠো আহার জোটাতে সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা ঝিয়ারি (গৃহকর্মী) মার। বাবা পুরোদস্তুর বেকার। চারজনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাছিমের মাকে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয় যাদের তাদের আবার কিসের পড়ালেখা’— চট্টগ্রাম নগরীর দুই নম্বর গেইট তুলাতুলী রেললাইনের বস্তিতে থাকা মানুষের এই একটাই কথা। দিনমজুরিতে চলা সংসারে দারিদ্র্যের ছোবলে প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল তাছিমের পড়াশোনা। এতো কিছুর পরেও তাছিমের মা চাইতেন ছেলে পড়ুক। অন্তত নিজে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য হলেও পড়াশোনাটা শিখুক। সময় পাল্টেছে, দিন বদলেছে— কিন্তু কারও কারও ঘরে দু বেলা আহার জোটাতেও যে হিমশিম খেতে হয় তাদের কি স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রাখা মানায়? জীবনের ছুঁড়ে দেওয়া হাজারো প্রশ্নের ভিড়ে হার না মেনে তাছিমের মা ছেলেকে নিয়ে এসেছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুল ‘চারুলতা বিদ্যাপীঠে’।

অনেক প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে এই ৯ জন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শেষ করেছে
অনেক প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে এই ৯ জন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শেষ করেছে

ঘড়ির কাঁটায় দুটোর ঘর ছুঁলেই ছুটোছুটি শুরু হয় স্কুলে যাবার। একবেলা আধবেলা খেয়ে না খেয়ে স্কুলে আসার তাড়া। সবার মতো গোল্ডেন কিংবা জিপিএ ৫ না পেলেও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় তাছিম সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে। চারুলতা বিদ্যাপীঠ থেকে এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পেয়েছে জিপিএ ৪.৮৩। স্বপ্ন একটিই— বড় হয়ে দেশের সেবা করা। সে ‘ডাক্তার’ হতে চায়।

তাছিমের মতো আরও আটজন চারুলতা বিদ্যাপীঠ থেকে তৃতীয়বারের মতন অংশ নিয়ে করেছে শতভাগ পাস। চারুলতা বিদ্যাপীঠের তৃতীয় ব্যাচে তাছিম, মিশাত, বৃষ্টি, আকলিমা, শামীম, হাসি, তানিয়া, হামিদা, নুপুর ওরা নয় জনই ছিল এবারের সমাপনীর পরীক্ষার্থী।

অনেক প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে এরা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শেষ করেছে। জিপিএ-৫ না পেলেও রাখতে পেরেছে মেধার পরিচয়। তাছিম ৪.৮৩, মিশাত ৪.৭৫, বৃষ্টি ৪.৫৮, আকলিমা ৪.৫৮, শামীম ৪.৩৩, হাসি ৪.১৬, তানিয়া ৩.৭৫, হামিদা ৩.১৬, নুপুর ৩.০৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। তাছিমের মতন সবার পরিবারে একই দুরাবস্থা। কারও বাবা দিনমজুর, কারও মা নানান জনের বাসায় কাজ করে আবার কারও বাবা রিকশাওয়ালা আবার কারও বাবা থেকেও নেই। তবুও থেমে নেই তাদের স্বপ্ন দেখা।

চারুলতা বিদ্যাপীঠের শিক্ষকদের দেখে ওদেরও স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে জাগে। কেউ ডাক্তার হতে চায়, কেউ শিক্ষক আবার কেউ পুলিশ। তাদের সকলেরই ইচ্ছে পড়াশোনা করে বড় হয়ে দেশের সেবা করা যাতে তাদের মতন কেউই পিছিয়ে না যায়।

২০১২ সালে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়াতে আসে চারুলতা বিদ্যাপীঠ। তাদের সহযাত্রীরা পিছনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে থেকে জুগিয়েছেন সাহস। তাদের কয়েকজন হলো ডা. ইমদাদ হোসেন, ডা. অভিক রায়হান, ডা. অসীম বড়ুয়া, সবুজ মন্ডল, সালাউদ্দিন রাশেদ, সৌমেন নন্দীসহ স্বপ্নবাজ কয়েকজন তরুণ। যাদের হাত ধরে এবারের সাথী ‘এরা নয়’ জন।

চারুলতা বিদ্যাপীঠ সংগঠনের সভাপতি মোমেনা খাতুন পুষ্প চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেক প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে এই ৯ জন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শেষ করেছে। ওরা স্বপ্ন দেখে আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার। তাদের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী চারুলতা সবসময় চায় এরা যাতে ঝরে না যায়। এদের মেধা আছে। কিন্তু কাজে লাগানোর মতন গড়ে উঠার পরিবেশটা পাচ্ছে না। চারুলতা চায় তাদের স্বপ্নপূরণের সারথী হতে।’

স্কুল কমিটির সভাপতি দ্বীপাঞ্জল রক্ষিত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জিপিএ ৫ আসলে সবকিছু না। এদের মেধা আছে কিন্তু এরা সেই পরিবেশটুকু পায় না। আবার কেউ কেউ পড়াশোনার ফাঁকে অন্য কাজও করে। কিন্তু তারপরও পড়তে চায়। বড় হতে স্বপ্ন দেখে। এই আলোদের সহযাত্রী হতেই আমরা চেষ্টা করছি। আর এরা এই প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যার উদাহরণ তাদের এই ফল।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!