এশীয় হাতি বৃহত্তর চট্টগ্রামে মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার

একবছরেই ১৮ হাতির মৃত্যু

পাহাড়ি মাটি কাটা-গাছকাটা চক্র, চোরাশিকারীরা ইলেকট্রিক শক দিয়েও মারছে হাতি

বুনো হাতির মৃত্যু কিংবা হত্যার শিকার হওয়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখন আর নতুন কিছু নয়। চলতি মাসের চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ও কক্সবাজারে তিন দিনে টানা তিন হাতির মৃত্যুতে বন বিভাগ যেমনটা উদ্বিগ্ন, তেমনি বন্যপ্রাণী গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এভাবে চলতে থাকলে স্থলভাগের সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীটি কোনো একসময় অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যেতে পারে।

গত ১২ জুন কক্সবাজার টেকনাফের হ্নীলায় খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসলে একটি বয়স্ক হাতি বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে এসে মারা যায়। ঠিক তার পরদিন ১৩ জুন বান্দরবানের লামার ফাঁসিয়াখালীতে পানির ছড়ায় মৃত অবস্থায় একটি হাতি পাওয়া যায়। সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনা ঘটে ১৪ জুন। এদিন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর পাথারিয়াখোলাতে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রাখা একটি হাতির খোঁজ পায় বনবিভাগ। এই হাতি উদ্ধার করার পর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মারা হয়েছে হাতিটিকে। এই নিয়ে বনবিভাগ থেকে প্রথমে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও পরে মামলা দায়ের করা হয় বলে জানান সাধনপুরের রেঞ্জ অফিসার।

ওই সময় বাশঁখালীর বৈলছড়ির স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের দাবি করেছিলেন, একটি চক্র নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে বন্যপ্রাণী হত্যায় মেতেছে। পাহাড়ি মাটি কাটা, গাছ কাটা, পাহাড়ি পানির ছড়া থেকে ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলনের সাথেও ওই চক্রটি জড়িত। রাতের আঁধারে লুকিয়ে পাহাড়ি গাছ ও মাটি কাটতে হাতির বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়— এটাই ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওই চক্রটির সামনে। এর জের ধরেই মূল্য বন্য হাতি হত্যা— বলছেন বন কর্মকর্তারা। এছাড়া সংঘবদ্ধ আরও কয়েকটি চক্র শরীরে ‘মূল্যবান জিনিস’ পাওয়ার আশায় বন্য হাতি ও শুকর মেরে ফেলছে পরিকল্পিতভাবে। এক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় নির্মম পদ্ধতি— ইলেকট্রিক শক।

গত জানুয়ারিতে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁওতে এই মা বন্যহাতিকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মৃত মা হাতির মরদেহটি পাহারা দিচ্ছিল তার বাচ্চাটি।
গত জানুয়ারিতে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁওতে এই মা বন্যহাতিকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মৃত মা হাতির মরদেহটি পাহারা দিচ্ছিল তার বাচ্চাটি।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বব্যাপী হাতি বিলীন হওয়ার মূলত প্রধান দুটি কারণ আবাসস্থল ধ্বংস আর হাতির দাঁতের জন্য শিকারীর দিয়ে হাতি নিধন। এর পাশাপাশি পাহাড়ি মাটি কাটা ও গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত চোরাকারবারিদের প্রায়ই হাতির বাধার মুখোমুখি হয়। এই বাধা সরাতে চোরাকারবারিরাও হাতি নিধনে নামে। গত বছর বিবিসির এক প্রতিবেদনে নতুন করে তুলে ধরা হয়েছিল এশিয়ান হাতির চামড়ার জন্য হাতি শিকারের কথা।

জানা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে শুধু কক্সবাজার অঞ্চলেই মারা গেছে সাতটা হাতি। কক্সবাজার উত্তরের বনবিভাগ কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম জানান, এর মধ্যে ‘রোগাক্রান্ত’ হয়ে কক্সবাজার উত্তর অঞ্চলে চারটি হাতি মারা যায়।

অন্যদিকে দক্ষিণ বনবিভাগের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, দক্ষিণে তিনটি হাতির মধ্যে দুটি হাতি ‘রোগে’ মারা গেছে। তবে সর্বশেষ টেকনাফের হ্নীলা মরিচ্যাঘোনা এলাকায় বৈদ্যুতিক শকে হাতি মারা যাওয়ার ঘটনায় তিনি বিদ্যুৎ অফিসের গাফিলতিকে দুষছেন। এ নিয়ে বনবিভাগ থেকে মামলা দেয়ার ব্যাপারটা প্রক্রিয়াধীন আছে বলে এই বনকর্মকর্তা জানান।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সাথে কথা হলে কক্সবাজার অঞ্চলের এই দুই কর্মকর্তা দাবি করেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আসার পর হাতির আবাসস্থল এবং করিডোর বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া বনের অভ্যন্তরে সরকারি অপরিকল্পিত উন্নয়নও এজন্য অনেকাংশে দায়ী। তবে বনবিভাগ থেকে সমস্যার কথা তুলে ধরা হলেও সরকারের কাছে যেটা প্রাধান্য পেয়েছে সেটিই করা হয়েছে বলে জানান দক্ষিণের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।

তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ করিডোর ছিল উখিয়া ঘুমধুম। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প করে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। হাতির আবাসস্থল পরিবর্তন হলে ঠিকমতো বিচরণ করতে পারে না।’

গত একবছরে সবচেয়ে বেশি ১৮টি হাতি মারা গেছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার অঞ্চলে। বাংলাদেশে যেসব হাতির দেখা মেলে তা হলো এশিয়ান প্রজাতির হাতি। এশিয়ান হাতিও এখন বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। এদিকে এভাবে একের পর এক হাতির ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ চলতে থাকলে বাংলাদেশ থেকে এশিয়ান হাতি বিপন্ন হতে বেশি সময় লাগবে না বলে ধারণা করছেন ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)।

এছাড়া হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে প্রতিনিয়ত। হাতির আক্রমণে মানুষ আহত-নিহতের সংখ্যাও কম নয়। ইদানিং হরহামেশাই শোনা যায় খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে চলে আসছে এই বন্য প্রাণীটি।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের হাতি মৃত্যুর প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, বন্য প্রাণীর সাথে মানুষের যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে তা মূলত এদের আবাসস্থল ধ্বংস এবং খাবারের জায়গা নষ্টের কারণে। খাবারের সন্ধানে এরা লোকালয়ে চলে আসে।’

বন্যপ্রাণীদের চলাচল ও বসবাসের জায়গা এবং যে রুট তারা ব্যবহার করে তা সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজনে কৃত্রিমভাবে খাবারের জোগান দেওয়ার পক্ষেও মত দিলেন তিনি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!