এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে উঠেছে ইপিজেড-পতেঙ্গার গলার কাঁটা

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাই মূল কারণ

চট্টগ্রামে ‘লালখানবাজার টু বিমানবন্দর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’র অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, যত্রতত্র যন্ত্রাংশ রাখাসহ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। টানা বৃষ্টি ও অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের ফলে খানাখন্দ ও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে ইপিজেড-পতেঙ্গা এলাকায় যানচলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে মূল সড়কের দুই পাশ। প্রতিদিন এসব গর্তে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে চলাচলরত গাড়ি। গত চার মাসে ইপিজেড-পতেঙ্গা সড়কে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে অন্তত আটজন, আহতের সংখ্যা অসংখ্য।

জানা যায়, পতেঙ্গা-ইপিজেড পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণস্থলে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা ও সড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়। সড়কে চলাচলরত গাড়িগুলো গর্তে পড়ে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত চার মাসে পতেঙ্গা ও ইপিজেড থানা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আটজন নিহত হয়েছে।

বৃষ্টি না হলে এলাকা পরিণত হয় ধুলোবালির রাজ্যে।
বৃষ্টি না হলে এলাকা পরিণত হয় ধুলোবালির রাজ্যে।

জুন মাসের শুরুতে অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের কারণে ওই এলাকা পরিণত হয় ধুলোবালির রাজ্যে। পথচারীদের চলাফেরাই হয়ে দাঁড়ায় কষ্টকর। নির্মাণকাজ শুরুর পর মার্চ-এপ্রিলের দিকে কোন সীমানাপ্রাচীর না থাকায় যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ভারী যন্ত্রাংশের কারণে প্রায়ই রাতে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতো বলে জানান স্থানীয়রা।

৪০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জানে আলম জানান, ‘সোমবার (১৫ জুলাই) সকালে আমার মেয়ে পরীক্ষা দিতে বের হয়। মহাজনঘাট এলাকায় গর্তে পড়ে গাড়িটি উল্টে যায়। এতে আমার মেয়েসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। ওইদিন মেয়েটি আর পরীক্ষায়ও অংশ নিতে পারেনি। প্রতিদিন ওই সড়কে কোন না কোন দুর্ঘটনা ঘটছে।’

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে উঠেছে ইপিজেড-পতেঙ্গার গলার কাঁটা 1
সামান্য বৃষ্টি হলেই যান চলতে পারে না।

কাটগড় এলাকার ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন জানান, ‘বৃষ্টির আগে কাটগড় থেকে বের হওয়ার কোন পরিস্থিতি ছিল না। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের কারণে পুরো এলাকা ধুলোর রাজ্যে পরিণত হয়। গত রোববার (১৪ জুলাই) সকালে একটি যাত্রীবাহী অটোরিকশা উল্টে গিয়ে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। এরপর ওইদিন রাত ১০টার দিকে গর্তে দুটি লরি পড়ে গেলে পুরো সড়কটিই বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন ইপিজেড থেকে ১০ মিনিটের পথ এসেছি দেড় ঘন্টায়।’

নির্বিচারে বৃক্ষনিধন

অভিযোগ রয়েছে, পতেঙ্গা, ইপিজেড ও সল্টগোলা ক্রসিং থেকে ভিআইপি সড়ক পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের অনুমতি ছাড়া নির্বিচারে পাঁচ শতাধিক গাছ কেটে ফেলেছে ম্যাক্স গ্রুপ। এর মধ্যে শতবর্ষী গাছই ছিল অনেকগুলো। এভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছে পরিবেশবিদরা। গাছনিধনে নিয়োজিত রয়েছেন জালাল নামের ম্যাক্সের এক ঠিকাদার। তিনি নিজেকে সিডিএএর তালিকাভুক্ত ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপে কর্মরত বলে দাবি করেছেন। জানা যায়, এসব গাছ আবার অবৈধভাবে বিক্রি করে ২৫ লাখ টাকার বাণিজ্য করেছে ওই ঠিকাদার।

চসিক সূত্রে জানা যায়, গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণস্থানে সড়কে ওপর থাকা প্রায় ২০০টি গাছের টেন্ডার দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এতে অপ্রয়োজনীয় কাছ না কাটার জন্য শর্ত দেওয়া হলেও শর্ত অমান্য করে টেন্ডারবর্হিভূত অসংখ্য গাছ নিধন করে ম্যাক্স গ্রুপের কর্মীরা।

গ্যাসলাইন কাটা পড়ে মানুষের দুর্ভোগ

জানা যায়, গত ৭ জুলাই ইপিজেড থানার মহাজনঘাট এলাকায় রাতে সড়কের মাটি কাটতে গিয়ে একটি হাইপ্রেসার গ্যাসলাইন কেটে ফেলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের কর্মীরা। ঘটনার পর কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (কেজিডিসিএল) গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। গ্যাস বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়ে নির্মাণ এলাকার প্রায় দুই লাখ গ্রাহক। পরে প্রায় ২১ ঘন্টা পর গ্যাস সরবরাহ পুনরায় চালু হয়। এর আগে গত জুন মাসের শেষের দিকে রাতে সিমেন্স হোস্টেল এলাকায়ও একইভাবে মাটি কাটতে গিয়ে গ্যাসলাইন কেটে ফেলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের কর্মীরা। পরে চেষ্টা চালিয়ে গ্যাস সংযোগ সচল করে কেজিডিসিএল।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের গাফেলতি প্রসঙ্গে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ম্যাক্সের প্রজেক্টের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা যেন যত্রতত্রে যন্ত্রাংশ না রাখেন। একটি গর্ত করার পর সেটি ভরাট করে যেন অপরটি খোঁড়া হয়। কিন্তু তারা আমাদের কোন কথাই আমলে নিচ্ছে না। নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করায় এখানকার ২০ লাখ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। প্রতিদিন কোন না কোন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটছে। পরিকল্পনা করে কাজ না করলে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছি।’

বন্দরের পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) তারেক আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সামান্য বৃষ্টি হলেই সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত কোমর পানির কারণে কোন যান চলতে পারে না, যান চলে থেমে থেমে। সড়কে বড় বড় গর্ত হওয়ায় পতেঙ্গার দিকে সড়কে একটি-দুটি করে গাড়ি চলছে। এছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স শুরু থেকে নির্মাণকাজে হেলাফেলা করায় প্রতিদিন সড়কে কোন না কোন দুর্ঘটনা ঘটছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কাউকে (ম্যাক্স গ্রুপের) ফোনেও পাচ্ছি না।’

তারেক আহমেদ আরও বলেন, ‘যানজটের কবল থেকে এড়াতে প্রতিদিন হজ ফ্লাইট ও বিদেশগামী যাত্রীদের চিহ্নিত পারলে তাদেরকে উল্টোপথে যাওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। সকাল থেকে ডিপো ও বন্দরের বড় বড় ভারী যানের কারণে ধীরগতিতে চলছে ওই সড়কের ছোট-বড় যান।’

মুঠোফোনে কল ও এসএমএস দিয়েও ম্যাক্স গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার মো. আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ম্যাক্সের কারণে কেন দুর্ঘটনা ঘটবে? ইপিজেড-পতেঙ্গার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণসীমানা টিনের প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা আছে। সীমানার ভেতরে ঠিকাদারদের নিয়োজিত শ্রমিকরা কাজ করছে। ঠিকাদার যদি কোন ফল্ট করে তার দায়দায়িত্ব তো আমাদের নয়।’

নিমার্ণস্থলে ধুলোর দুর্যোগ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘লোকজনের চলাফেরার সুবিধার্থে নির্মাণস্থলে ধুলো কমানোর জন্য পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অদক্ষ কর্মীদের গাফেলতিতে বারবার গ্যাসলাইন কেটে ফেলা ও নির্বিচার গাছ নিধনের বিষয়ে সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে তিনি ঠিকাদারদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার পরামর্শ দেন।

একনজরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নেওয়া প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আগামী চার বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। প্রকল্পের বাস্তবায়নে রয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র‌্যাঙ্কিন জেভি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!