করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে সৌদি আরবে সীমিত পরিসরে শুরু হওয়া হজের অংশ হিসেবে আরাফাত ময়দানে সমবেত হয়েছেন হাজিরা। বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) পবিত্র এই ময়দানে সমবেত হয়েছেন এবারে সুযোগ পাওয়া দশ হাজার হাজি। প্রতিবছর হজে সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ ইসলাম ধর্মাবলম্বী যোগ দিলেও এবারের পরিস্থিতি আলাদা। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কেবল সৌদি আরবে অবস্থানরত নির্বাচিত ব্যক্তিরাই সুযোগ পেয়েছেন। তারপরও ভাইরাসটি থেকে সুরক্ষায় হজের সময়ে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি হজ শুরুর আগে দুই ধাপে কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আনুষঙ্গিক স্থাপনাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হজের সময় সবাইকে মাস্ক পরার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হাজিদের প্রত্যেকের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ আরাফাত ময়দানে সমবেত হওয়া। আগের দিন মিনায় রাত্রি যাপনের পর জিলহজ মাসের নয় তারিখের (এবারে ৩০ জুলাই, বৃহস্পতিবার) সকাল থেকেই আরাফাত ময়দানে জড়ো হতে শুরু করেন মুসল্লিরা। মিনা থেকে ১০ কিলোমিটার হেঁটে এখানে যেতে হয়। হাজিরা নামিরা মসজিদ থেকে দেওয়া খুতবা শোনার পর জোহর ও আসরের নামাজ একইসঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করবেন। তারপর হজ কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া ও কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে সূর্যাস্তের অপেক্ষা করবেন। সূর্যাস্তের পর হাজিরা মাগরিবের নামাজ আদায় না করেই আরাফাতের ময়দান থেকে রওনা দেবেন মুজদালিফার দিকে। সেখানে পৌঁছে মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করবেন। খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করবেন হাজিরা। তারপর মিনার জামারায় (প্রতীকী) শয়তানকে নিক্ষেপের জন্য পাথর সংগ্রহ করবেন। পরদিন (শুক্রবার) সকালে ফজরের নামাজ শেষে হাজিরা আবার ফিরে আসবেন মিনায়। জামারাতে পাথর নিক্ষেপ ও পশু কোরবানির পর পুরুষরা মাথা মুণ্ডন করে ইহরাম ত্যাগ করবেন। এরপর পবিত্র কাবা শরিফে বিদায়ী তাওয়াফ করে হজের পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা শেষ করবেন হাজিরা।
বৃহস্পতিবার আরাফাত ময়দানে হাজিদের স্বাগত জানাতে স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা রেখেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। অতিরিক্ত গরম বা তাপজনিত অসুস্থতায় আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আরাফাত ও মুজদালিফা থেকে হাজিরা চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এসব জায়গায় থাকবে ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালও। করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়াদের জরুরিভিত্তিতে আলাদা করে ফেলার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তবে হজের প্রথম দিনে কোনও হাজির করোনা শনাক্ত হয়নি বলে জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
এবারের হজের প্রতিটি ধাপ নিরাপদ করতে নতুন নতুন প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, এবারের হজের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এমন হজ আগে কখনও দেখেনি বিশ্ব। হাজীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষার জন্য প্রতিটি পয়েন্টে বসানো হয়েছে থার্মাল স্ক্যানার। অংশগ্রহণকারীদের সহজে ট্র্যাক করতে প্রত্যেককে ই-পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, সকলের সেলফোন একটি অ্যাপসের অধীনে সংযুক্ত করে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে, মক্কায় প্রবেশের সঙ্গেসঙ্গেই সকল অংশগ্রহণকারীকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি জিপিএস রিস্টব্যান্ড পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই রিস্টব্যান্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের অবস্থান জানান দিবে। তাদের মধ্য থেকে, ২০ জন করে নিয়ে এক একটি গ্রুপ করা হয়েছে। হজের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা এই গ্রুপের ভিত্তিতেই করতে হবে।
ইহরামের কাপড়ে সিলভার ন্যানো টেকনোলজি যুক্ত করা হয়েছে। এটি কাপড়ের ব্যাক্টেরিয়াকে মেরে ফেলতে সাহায্য করবে এবং কাপড়কে পানি নিরোধক করবে।
এ ব্যাপারে আরব নিউজ জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে হজের প্রতিটি ধাপেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
হজে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার নিয়ে সৌদির হজ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য পরিকল্পনা কর্মকর্তা আমর আল মাদ্দাহ বলেছেন, হজপ্রক্রিয়া ভালভাবে শেষ করতে প্রযুক্তিই তাদের কালো ঘোড়া। কোভিড-১৯ সংক্রমণের কোনো ঘটনা এবং মৃত্যু ছাড়াই যেন হজ শেষ হয় তা নিশ্চিত করতে সকল ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এর আগে, হজের জন্য মনোনীত প্রত্যেকের করোনা পরীক্ষা করানো হয়েছে। হজ শুরুর আগে ও পরে দুই ধাপে সবার জন্য কোয়ারেনটাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। হজের পুরো সময়ে স্বল্প সংখ্যক হাজীকে বারবার করোনা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। হজ চলাকালে কেউ আক্রান্ত হলে সঙ্গেসঙ্গে তাকে আইসোলেশনে পাঠানো হবে।
অন্যদিকে, জমজমের পবিত্র পানি পানেও থাকছে নিয়মের কঠোরতা। এবার সবার জন্য জমজমের পবিত্র পানি সরবরাহ করা হবে প্লাস্টিকের প্যাকেটে। হজের অবশ্য পালনীয় ধাপের একটি হলো আরাফার ময়দানে অবস্থান। আরাফায় হাজীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণেও সার্বক্ষণিক প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষনীয়।
শয়তানকে পাথর ছোঁড়ার আনুষ্ঠানিকতাতেও থাকছে নতুনত্ব। এবার সর্বোচ্চ ৫০ জন হাজী একসঙ্গে পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন। কর্তৃপক্ষ বিশেষ ধরনের জীবাণুমুক্ত পাথর সরবরাহ করবেন হাজীদের।
উল্লেখ্য, ইসলামের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের একটি হচ্ছে পবিত্র হজ। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ পালন করা অবশ্য কর্তব্য বলে বিশ্বাস করা হয়। ধারাবাহিকভাবে ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্যদিয়ে হজ পালন করতে হয়।
এমএহক