এক লোকের হাতেই ৫ বছরে ১৪০০ কোটি টাকা হাওয়া আমদানির আড়ালে

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানির নামে গত পাঁচ বছরে অন্তত ১৪০০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে শুধু একটি চক্রই। ভুয়া কোম্পানি ও দলিল তৈরি করে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতো চক্রটি। পণ্য আমদানি থেকে খালাস পর্যন্ত যাবতীয় সব কাগজ তৈরি করা হয় জাল। এমনকি শুল্কায়নের কাগজও জাল তৈরি করে তারা। এসব শুল্ক ফাঁকির টাকা তারা পণ্য আমদানির আড়ালে এলসির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছে।

পাচার চক্রের মূল হোতা শহিদুল আলমকে (৫৬) গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত ১৩ আগস্ট বিদেশে পালানোর সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তাকে গ্রেপ্তার করে।

জানা গেছে, ভুয়া নাম-ঠিকানা ও দলিলের মাধ্যমে ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদ, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, আমদানি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক হিসাব ও এলসি খুলে মেশিনারি আমদানির ঘোষণা দিয়ে উচ্চ শুল্কের মদ, সিগারেট, এলইডি টিভি ইত্যাদি পণ্য অবৈধভাবে আমদানি করেন শহিদুল। এভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন মোট ১ হাজার ৩৯৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এসব টাকা আবার পণ্য আমদানির নাম দিয়ে এলসির মাধ্যমে পাচার করেছেন বিদেশে।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর জানায়, ঢাকার খিলক্ষেতের ‘হেনান আনহুই এগ্রো এলসি’ এবং কেরাণীগঞ্জের ‘এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি’ নামের প্রতিষ্ঠান দুটি চীনের জমরাজ ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে আমদানি করা ৭৮ কন্টেইনার পণ্য খালাস নেয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে।

অপরদিকে ঢাকার খিলগাঁও শেখেরটেক এলাকার ‘হেব্রা ব্রাহ্মো’ ও নারায়ণগঞ্জের পাগলার নন্দলালপুর এলাকার ‘চায়না বিডিএল’ নামের প্রতিষ্ঠানও চীন এবং সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করেন প্রায় ২৫ কন্টেইনার পণ্য। যেখানে সবগুলো পণ্য চালানে ছিল মিথ্যা ঘোষণা। যা খালাস হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই।

এভাবে চারটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১০৩ কন্টেইনার পণ্য চালান খালাস করেছেন শহিদুল।

‘মেসার্স এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি’ নামের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার পল্টন থানায় ৪৩১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পাচারের দায়ে ৯টি মামলা দায়ের করা হয়। ‘হেনান আনহুই এগ্রো এলসি’ নামের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪৩৯ কোটি ১১ লাখ টাকা পাচারের দায়ে ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়। ‘হেব্রা ব্রাহ্মো’ নামের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একই বছরের ১২ নভেম্বর ২৯০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা মানিলন্ডারিংয়ের দায়ে সাতটি মামলা দায়ের করা হয়।

এছাড়া ‘চায়না বিডিএল’ নামের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর ২৩৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা মানিলন্ডারিংয়ের দায়ে সাতটি মামলা দায়ের করা হয়।

ঢাকার কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শাকিল খন্দকার বলেন, ‘ভুয়া কোম্পানি ও আমদানির ভুয়া দলিল বানিয়ে ১ হাজার ৩৯৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা পাচার করেছেন শহিদুল আলম। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আমরা বেশ কিছু ভুয়া আমদানিকারককে ধরতে কাজ শুরু করেছি।’

ঢাকার কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মানস কুমার বর্মন বলেন, ‘হেনান আনহুই এগ্রো এলসি নামের প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালের বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৪৬ কন্টেইনার পণ্য খালাস করে নেয়। পোল্ট্রি ফিডের নাম করে বিপুল পরিমাণ সিগারেট, এলইডি টেলিভিশন, ফটোকপিয়ার মেশিন ও মদ আনে প্রতিষ্ঠানটি। এ ঘটনায় আব্দুল মোতালেব নামের একজনকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় পল্টন মডেল থানায় ২০১৭ সালে মামলা করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘পরে শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তর এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে। এতে দেখা যায়, ১৫টি এলসির বিপরীতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কন্টেইনার ভর্তি ওইসব পণ্য খালাস করা হয়েছে। একই ঘোষণায় এর আগে ২০১৫ সালের বিভিন্ন সময়ে ২৫ কন্টেইনার পশুখাদ্য তৈরির যন্ত্রপাতি আমদানি করে নারায়ণগঞ্জের পাগলার নন্দলালপুর এলাকার চায়না বিডিএল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সিঙ্গাপুরের ইস্তাম্বুল ট্রেডিং এবং চীনের রাপাতি এন্টারপ্রাইজ থেকে এসব পণ্য আমদানি করা হয়। অবশেষে দীর্ঘ তদন্ত শেষে এসবের মূলহোতা শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!