এক ডাক্তারের স্বেচ্ছাচারে ধুঁকছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতাল

কন্ট্রাক্টে সিজার বাণিজ্য, অনিয়মের ওভারটাইম

নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থপনায় চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাটে সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতাল এখন নিজেই ধুঁকছে। এর ফলে হাসপাতালটি এখন আর নগরবাসীর কোনো কাজেই আসছে না। ভেঙে পড়েছে প্রশাসনিক শৃঙ্খলাও। সংশ্লিষ্টরা এজন্য সেখানে কর্মরত একজন চিকিৎসকের স্বেচ্ছাচারিতাকে দায়ী করেছেন। এই চিকিৎসকের নাম দীপা ত্রিপুরা।

চাকরির নির্ধারিত সময়ে কাজ করেন ডাক্তার দীপা ত্রিপুরা। বেতন নেন। আবার নির্ধারিত সময়ের কাজকে ওভারটাইমের (অতিরিক্ত সময়) কাজ দেখিয়ে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। এমনকি একদিনে নয়টি অপারেশন ওভারটাইমে দেখিয়ে ১৮ হাজার টাকা বাড়তি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অস্থায়ী হয়েও নিয়ম বহির্ভূতভাবে পদোন্নতি নিয়ে হয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। অথচ তার চেয়েও অনেক সিনিয়র স্থায়ী চিকিৎসক সংস্থাটিতে রয়েছেন। এদিকে দীপার বিরুদ্ধে কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে সিজার বাণিজ্য করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

এখানেই শেষ নয়, অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি করা চিকিৎসক দীপার অনিয়ম। ওই হাসপাতালে তার ইচ্ছায় চলে সবকিছু। সিটি কর্পোরেশন হাসপাতালে চিকিৎসাপ্রার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় দীপার পছন্দের প্রাইভেট ক্লিনিকে। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত কাজে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস করে না। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আশকারায় দীপা গড়েছেন এসব অনিয়মের পাহাড়। সদরঘাটের সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) হিসেবে ছিলেন তিনি। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ওই হাসপাতালের ইনচার্জও তিনি।

বিস্ময়কর হচ্ছে, আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা বা আরএমও পদ থেকে সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে দীপাকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই পদোন্নতি নিয়ম বহির্ভূতভাবে দেওয়া হয়েছে।

সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হতে এমপিএইচ (মাস্টার অফ পাবলিক হেলথ) ডিগ্রি অর্জন করা প্রয়োজন। এই ডিগ্রি নিতে এক বছর বাধ্যতামূলক ছুটিতে থাকতে হয়। কিন্তু চসিকে কর্মরত অবস্থায় এমপিএইচ ডিগ্রি নিয়েছেন দীপা। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেছেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী চাকরিরত অবস্থায় কেউ পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নিতে পারেন না। ডিগ্রি নিতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জানিয়েই ছুটি নিতে হয়।

স্থায়ী চাকরিজীবী ও সিনিয়র চিকিৎসকরা প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মতামতে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। সিনিয়র চিকিৎসকদের টপকে ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মতামত ছাড়া রীতিমতো অলৌকিকভাবে পদোন্নতি পেয়েছেন দীপা ত্রিপুরা। ৩ জানুয়ারি চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (প্রিভেনটিভ) পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় দীপাকে। ওই পদে একজন কর্মরত থাকার পরেও দীপাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আকতার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই পদোন্নতি নিয়ে আমি কিছু জানি না। আমার কাছ থেকে এই পদোন্নতি নিয়ে কোন মতামত চাওয়া হয়নি। এখানে তার চেয়েও অনেক স্থায়ী সিনিয়র চিকিৎসক আছেন।’

তবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলম বলেন, ‘নিয়ম মেনে যোগ্যতার ভিত্তিতে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। হাইয়ার অথরিটি যেটা চায় সেটাই তো হবে। বিভাগীয় প্রধান বা কাউকে জানিয়ে করতে হবে সেরকম তো কোন আইন নাই। সিটি কর্পোশেনের স্বার্থে যাকে যেখানে দেওয়া দরকার, সেখানে দেওয়া হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. দীপা ত্রিপুরা চাকরির নির্ধারিত সময়ে রোগী দেখতেন ও হাসপাতালে সার্জারি ইউনিটে কাজ করতেন। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের সিজার করান তিনি। নির্ধারিত সময়ে সিজার করলেও ওভারটাইম দেখিয়ে প্রতি সিজারে দুই হাজার টাকা করে নেন এই চিকিৎসক।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ৩৬টি সিজারিয়ান অপারেশন ওভারটাইমে দেখান দীপা ত্রিপুরা। সিজারগুলোর বিপরীতে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫০ টাকা আদায় করা হয় রোগীদের কাছ থেকে। দীপা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ, ওই হাসপাতালে কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে তিনি সিজার বাণিজ্য করেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতালের আরএমও ও ইনচার্জের দায়িত্ব দীপার হাতে থাকায় এসব অনিয়ম সম্ভব হয়েছে খুব সহজে। ইনচার্জের দায়িত্ব পাওয়ার আগে দীপা ত্রিপুরার ব্যক্তিগত চেম্বার ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল এলাকায়। ইনচার্জ হওয়ার পর নিজের চেম্বার সরিয়ে নেন সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালের পাশে। জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশনের ওই হাসপাতালের রোগীদের তিনি নিয়ে যান পাশেই নিজের চেম্বারে।

শনিবার (১৮ জুন) রাতে ডাক্তার দীপা ত্রিপুরা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওভারটাইম দেখিয়ে টাকা নেওয়ার বিষয়টি মিথ্যা।’

স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি, সিজার বাণিজ্য ও ব্যক্তিগত কাজে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি চেম্বারে রোগীর সামনে আছি। কথা বলতে পারছি না। এ বিষয়ে আমি মোবাইলে কথা বলতে চাই না। আপনি আগামীকাল হাসপাতালে আসনে। বসে কথা বলবো।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!