মহান বিজয়ের মাসের তৃতীয় দিন আজ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই চূড়ান্ত পরিণতি দিকে এগুতে থাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ। প্রতিদিনই বদলাতে থাকে যুদ্ধের পরিস্থিতি। চারদিক থেকে মুক্তি বাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পরে পাক সেনারা। ৭১ এর আজকের এই দিনে যুদ্ধ মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। পাকিস্তান সরকার যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে ভারতকে।
এদিনে পাকিস্তান ভারতীয় বিমানঘাঁটিগুলোতে বোমাবর্ষণ ও পশ্চিম সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ শুরু করলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
অপারেশন চেঙ্গিস খান নামে পরিচিত পাকিস্তানের এই অভিযান যখন চলছিল তখন কলকাতায় এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। টাইম ম্যাগাজিন জানাচ্ছে, নয়াদিল্লীতে সহসা অন্ধকার নেমে এলো। সন্ধ্যা ৬টায় ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোতে সাংবাদিকরা একত্র হয়েছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধের খবর সংগ্রহের নিয়মিত কাজে। তখন বিদ্যুৎ চলে গেলে প্রেস ব্রিফিংয়ে আসা কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা ব্ল্যাক আউটের মহড়া নয়, আসল ঘটনা। এইমাত্র আমরা জানলাম, পাকিস্তানি বিমানবাহিনী অমৃতসর, পাঠানকোট ও শ্রীনগরে হামলা করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা সফরকালে ব্রিগেড প্যারেড ময়দানের সভা সংক্ষেপ করে সন্ধ্যায় হঠাৎ দিল্লী রওয়ানা হন। রাতে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে তিনি বলেন, পাকিস্তান আজ ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। ভারতকে এ যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হবে। পাকিস্তানের আক্রমণ ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রতিহত করতে হবে।’
পরদিন লোকসভার অধিবেশনে ইন্দিরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বিষয়ে বক্তব্য দেন। এভাবে এ দিনেই পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়।
কুমিল্লায় মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালায়। ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার দখল করে নেন। আখাউড়ার আজমপুর স্টেশনে দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দিনভর যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সিলেটের ভানুগাছায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। নোয়াখালীতে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সোনাইমুড়ি মুক্ত করে। এরপর তারা চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়।
মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাইজদীতে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। রংপুরের পলাশবাড়িতে ১২ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। সাতক্ষীরা থেকে পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে যায় পাকবাহিনী।
পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়। এদিন ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী কামালপুর বিওপি আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
এদিকে পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের জের ধরে এ দিনে গঠন হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী সম্মিলিতভাবে পূর্ব সীমান্তে অভিযান শুরু করে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাক অবস্থানকে ঘিরে ফেলার প্রচেষ্টায় সীমান্তের ৭টি এলাকা দিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করে। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্য ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি হয়।
এদিন জুমার নামাজের পর ভারতীয় হামলার প্রতিবাদে একটি মিছিল চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করে লালদীঘি ময়দানে জড়ো হয়। জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আল-মাদানির সভাপতিত্বে এ সভায় বক্তব্য রাখেন কনভেনশন লীগ প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরী, পিডিপির মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, ছাত্রনেতা আবু তাহের প্রমুখ।
তথ্যসূত্রঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, মূলধারা’৭১, বিবিসি নিউজ আর্কাইভ,ইত্তেফাক
এসএস