এই বর্ষায়ও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিয়ে আশার বাণী নেই

১২ মাসে ৩৮ ওয়ার্ডে এক কোটি ৬৭ লাখ এসএফটি ময়লা খাল ও নালা থেকে তোলা হয়েছে ঠিক। চলছে আরও নানা কর্মযজ্ঞ। তবু আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই বর্ষায়ও জলাবদ্ধতা নিয়ে আশার বাণী শোনাতে পারছে না কোনো সংস্থাই। সিডিএর মেগা এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর প্রকল্পের কাজ শুরুর দিকে খাল সংস্কার করলেও অধিকাংশ খালই এক বছরের মাথায় ফিরে গেছে পুরেনো চেহারায়। পরিষ্কার হওয়া খালগুলো ভরে গেছে ময়লা আবর্জনায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে প্রকল্পটির সুফল কতটুকু পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে খোদ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মাঝেও।

শনিবার (৪ মে) সকাল ১১টায় নগরীর দামপাড়াস্থ সেনাবাহিনীর (ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্রিগেড) ইসিবি মিলনায়তনে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় উঠে আসে এমন আশংকার কথা। পুরো প্রকল্প নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন ৩৪ ইসিবির ডিরেক্টর জেনালের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিকী।

মতবিনিময় সভায় পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের নানা দিক তুলে ধরেন অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক লে. কর্ণেল আবু সাদাত মোহাম্মদ তানভীর।

৩৪ ইসিবির ডিরেক্টর জেনালের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিকী বলেন, প্রকল্পের আওতায় পরিষ্কার করা খালগুলো আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। পরিষ্কার হওয়া খালে ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এ বিষয়ে জনসচেতনতার জন্য আমরা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের নিয়ে ৪ টি বৈঠক করেছি। এসব সমস্যার সমাধানে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হচ্ছে। স্ব স্ব ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে তাদের পরিকল্পনাগুলো আমরা গ্রহণ করছি। প্রকল্পের সুফল পেতে হলে জনসচেতনতা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের ভূমিকা অনেক বেশি।

তানভীর মাজহার সিদ্দিকী বলেন, গত বছর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৪টি ওয়ার্ডের ৪৭টি ড্রেন থেকে ১ কোটি ২৫ লাখ ৮৮ হাজার ২৪ সিএফটি বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। চলতি বছর ১৪টি ওয়ার্ডে বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে ৪১ লাখ ৮ হাজার ৬০৫ সিএফটি। চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ ৫৫টি খালের মধ্য দিয়ে জোয়ারের পানি চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না ততক্ষণ চট্টগ্রাম শহর জলাবদ্ধতামুক্ত হবে না।

তিনি বলেন, প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের ৪০টি খালে টাইডাল রেগুলেটর নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনী ৫টি, সিডিএ ১২টি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড করছে ২৩টি রেগুলেটর। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৩৬টি খাল। বাকি ২২টি খাল প্রকল্পভুক্ত করতে হলে অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। প্রকল্পের আওতাভুক্ত খালগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ১৩টি খাল চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকিগুলো দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ে সংস্কার করা হবে।
শহরে ড্রেনগুলোর কানেকটিভিটি নেই। এছাড়া অবৈধ খাল দখল জলাবদ্ধতা নিরসনের সবেচেয়ে বড় বাধা। যে কোন মুল্যে দখলদারদের হাত থেকে খালগুলো উদ্ধার করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন সেনাবাহিনীর এ কর্মকর্তা।

মতবিনিময় সভায় জানানো হয়, প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে খাল ও ড্রেন থেকে ময়লা আবর্জনা অপসারণ, খাল পুনঃখনন, টাইডাল রেগুলেটর নির্মাণ, ড্রেন মেরামত ও পরিষ্কারকরণ এবং নতুন সাইড ড্রেন নির্মাণ, আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, সিল্ট ট্রাপ, বর্তমানের আরসিসি কালভার্ট ও ব্রিজ প্রতিস্থাপন, খালের তীর বরাবর রাস্তা নির্মাণ কাজ চলছে।

নগরীর জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে অবৈধ খালের জায়গা দখল, খালে ময়লা ফেলা, টাইডাল রেগুলেটরের অপ্রতুলতা, ইউটিলিটি সার্ভিসের জন্য পানি প্রবাহ ব্যাহত হওয়া, খাল ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনকারী ড্রেনের সংযোগ ব্যাহত হওয়া, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ না মেনে চলা, বিল্ডিং কোড না মেনে চলা এবং জমির অপব্যবহার, অপরিকল্পিতভাবে বন উজাড় ও পাহাড় ধ্বংসকরণ, পলি জমির কারণে প্রবাহ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিল্প কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন করাকে চিহ্নিত করা হয়।

প্রকল্পের জন্য কয়েকটি সুপারিশ রাখা হয়েছে। খাল ও ড্রেনসমূহে ময়লা আবর্জনা না ফেলার জন্য সচেতনতা তৈরি করা, জরুরিভিত্তিতে প্রকল্পের আওতাধীন ব্রিজ কালভার্ট থেকে ইউটিলিটি হতে ইউটিলিটি লাইন স্থানান্তর, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের মাধ্যমে অবৈধ উচ্ছেদ কার্যক্রম বাস্তবায়ন, স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে সকল সংস্থা কর্তৃক ৪০ টি টাইডাল রেগুলেটর একই সংস্থা নির্মাণ সম্পন্ন করা।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লে.কর্ণেল মো. মহিউদ্দিন বলেন, নগরের ৩৬ টি খাল সংস্কার করা গেলে জলাবদ্ধতা থাকবেনা। সংস্কার হওয়া খালগুলোতে পুনরায় আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রকল্পের অগ্রগতি। টাকা দিয়ে বর্জ্য কেনার এটি প্রকল্পের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে সিটি কর্পোরেশন।

সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস বলেন, সারা বাংলাদেশে আইন না মানার প্রবণতা রয়েছে। প্রতি ঘরে ঘরে গিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। জলাবদ্ধতা দূর করতে অন্তত কর্ণফুলী নদীতে দুই বছর পর পর ড্রেজিং করতে হবে। এছাড়া দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। এটি অনেক চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। কারো দিকে না তাকিয়ে উদ্ধার অভিযান চালালে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জলাবদ্ধতাবিষয়ক প্রকল্পের পরিচালক কর্ণেল মো. নাসির উদ্দিন, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক লে. কর্ণেল আবু সাদাত মোহাম্মদ তানভীর, প্রকল্প কর্মকর্তা-১ মেজর মাহমুদ হাসান, প্রকল্প কর্মকর্তা -২ মেজর শাহনেওয়াজ মাহমুদ, কণফুলী গ্যাসের ডেপুটি ম্যানেজার মিলন মাহমুদ, ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী রানা চৌধুরী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান প্রমুখ।

এসসি/এডি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!