এই অস্ত্র তাহলে কার— অস্ত্র গুঁজে দিয়ে লোক ফাঁসানোর ঘটনায় তোলপাড় বাঁশখালী

সন্দেহের তীর শেখেরখীলের চেয়ারম্যান ইয়াছিনের দিকেই

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখীলে নিরীহ এক ব্যক্তিকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাস্থল পুঁইছড়ির বহদ্দারহাট রাস্তার মাথা এলাকায় কোনো অস্ত্র কিংবা গোলাগুলির প্রমাণ পায়নি পুলিশ। যে কারণে কথিত সেই ‘অস্ত্রধারী’ নুরুল কাদেরকে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন পুলিশ অস্ত্র ও গুলি কোথা থেকে আসলো সে বিষয়ে তদন্ত চালাচ্ছে। গত বুধবার বিকালে সিএনজিচালক নুরুল কাদেরকে অস্ত্রসহ পুলিশে সোপর্দ করা শেখেরখীলের চেয়ারম্যান ইয়াছিন তালুকদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমরা ঘটনার তদন্ত করে ওই লোক (নুরুল কাদের) কোনো ক্রাইমের সাথে জড়িত নয় বলে প্রমাণ পেয়েছি। যে কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন অস্ত্রটি কোথা থেকে আসলো সে বিষয়ে তদন্ত করছি। তদন্ত শেষেই বলতে পারবো ঘটনাটি কেন এবং কারা ঘটিয়েছে।’

বাঁশখালী থানার ওসি মো. শফিউল কবীর বলেন, ‘চেয়ারম্যান ইয়াছিনের ফোন পেয়ে গেলে অস্ত্রসহ এক ব্যক্তিকে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করেছি। যে দোকান থেকে ওই ব্যক্তিকে ধরা হয়েছে সেই দোকানের মালিকসহ স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছি। প্রত্যেকেই জানিয়েছে একটি চা দোকান থেকে ওই ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যায় চেয়ারম্যানসহ তার লোকজন। সে সময় ওই ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি। কিন্তু চেয়ারম্যান কার্যালয়ে লোকটিকে আমাদের কাছে অস্ত্রসহ সোপর্দ করা হয়। লোকটি নির্দোষ জানতে পেরে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমরা অস্ত্রটি কোথা থেকে আসলো সে বিষয়ে তদন্ত করছি। চেয়ারম্যানকেই বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। আমরা জড়িত কাউকে ছাড় দেব না।’

বহদ্দারহাটস্থ নোয়া মসজিদ এলাকার আজমগীর স্টোর নামে যে চা দোকান থেকে নুরুল কাদেরকে তুলে নেওয়া হয় সেই দোকানের মালিক বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বলেন, ‘আমার দোকানে ঘুমিয়ে ছিল কাদের। সেসময় প্রথমে লাঠিসোটা নিয়ে চেয়ারম্যানের ভাতিজা ইকবালের নেতৃত্বে তিনজন লোক গাড়ি থেকে নেমে কাদেরকে খুঁজতে থাকে। আরেকটি সিএনজিতে করে চেয়ারম্যান ইয়াছিন নিজে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে আসে। তারা নুরুল কাদেরকে ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলে। এসময় চেয়ারম্যান গাড়ি থেকে নামেনি। তাদের হাতে লাঠি থাকায় এবং কাদেরকে মারধর করতে দেখে ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেনি। পরে শুনেছি তাকে অস্ত্র দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। অথচ ঘটনাস্থলে কাদেরের কাছ থেকে কোনো অস্ত্র পায়নি। এমনকি এখানে কোনো গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেনি।’

পান ব্যবসায়ী আবু তাহের বলেন, ‘ডাকাত ধরেছে খবর পেয়ে চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে গিয়ে নুরুল কাদেরকে দেখে অবাক হই। তার হাতে চেয়ারম্যান একটি অস্ত্র ধরিয়ে দেয়। পুলিশের সামনে মানুষজনকে চেয়ারম্যান জিজ্ঞাসা করে অস্ত্রটি কার কাছ থেকে পেয়েছি? উপস্থিত লোকজন বলে কাদেরের কাছ থেকে। তবে সেখানে থাকা সব মানুষই ইয়াছিনের।’

নোয়া মসজিদের ইমাম আব্দুর রহিম বলেন, ‘মানুষটির ওপর চেয়ারম্যান ইয়াছিন অমানুষিক নির্যাতন করেছে। ব্যাপক মারধর করা হয়েছে। তার সাথে সম্পূর্ণ অন্যায় করেছে। আমরা ঘটনার বিস্তারিত পুলিশকে বলেছি। ঘটনাটি সাজানো। আমরা চাই প্রকৃত ঘটনা উঠে আসুক। অস্ত্রটি কার বের করতে হবে।’

পুলিশের হেফাজত থেকে ছাড়া পেয়ে বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন নুরুল কাদের। তিনি মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি এই ঘটনার বিচার চাই। আমি ইয়াছিনের কারণে নিজ বাড়ি ছেড়ে পুঁইছড়িতে ভাড়া বাসায় থাকি। আমি ছেলের দোকানে গেলে সেখান থেকে আমাকে মারধর করে অস্ত্র দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। এই ডাকাত চেয়ারম্যানের কাছে অনেক অস্ত্র আছে। আমি পুলিশসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। সে গত একমাস আগেও আমাকে ধরে নিয়ে মারধর করে হাত ভেঙে দিয়েছে।’

তবে শেখেরখীলের চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিন তালুকদার দাবি করেছেন, ‘নুরুল কাদের একজন ডাকাত। তার কাছ থেকেই অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখন কেউ যদি বলে তাকে ফাঁসানো হয়েছে তাহলে তারা ভালো কাজ করছে না। আমার সাথে তার কোনো শত্রুতা নেই। সে আমাকে গুলি করেছে বলেই ধরেছি।’

এর আগে আরও দুই দফা হামলা
গত এক মাস আগেও চেয়ারম্যান ইয়াছিনসহ তার লোকজন নুরুল কাদেরকে ব্যাপক মারধর করে। তাদের মধ্যে আর্থিক লেনদেন থাকার কথাও লোকেমুখে প্রচার আছে। সেসময় মারধরের কারণে কাদেরের হাত ভেঙ্গে যায়। এখনও কাদেরের হাতে সেই ব্যান্ডেজ রয়েছে।

গত মঙ্গলবারও নুরুল কাদেরকে মারধর করেন চেয়ারম্যানের লোক পরিচয়ধারী শেখেরখীল লালজীবন এলাকার বাসিন্দা আরেক নুরুল কাদের মাঝি। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে ছেলের দোকান থেকে নুরুল কাদেরকে তুলে নিয়ে যেতে চায় নুরুল কাদের মাঝি। সে সময় নুরুল কাদের মাঝি বলেন চেয়ারম্যান ইয়াছিন তাকে পাঠিয়েছে। আমরা তখন তাদের ধাওয়া দিলে পালিয়ে যায়। এর জের ধরেই বুধবার নুরুল কাদেরকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে।

পুঁইছড়ি এলাকার বাসিন্দা ও মঙ্গলবার রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাবুল বলেন, ‘লালজীবন এলাকার নুরুল কাদের মাঝি চেয়ারম্যানের লোক পরিচয় দিয়ে নুরুল কাদেরকে তুলে নিতে চাইলে আমাদের বাধায় নিতে পারেনি। পরে চেয়ারম্যান নিজে এসে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। অস্ত্রটি কার এবং কেন দিল তার তদন্ত চাই। এসব ঘটনার বিচার না হলে নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!