ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আমিষের অভাব মেটায় যারা

চট্টগ্রামের জেলেপল্লীতে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র

ওদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নেই, অভাব-অনটন ওদের পিছু ছাড়ে না। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও সাগরের বিশাল ঢেউয়ের শব্দের নিচে চাপা পড়ে যায় তাদের কান্না। চট্টগ্রাম মহানগরীর জেলেপল্লীতে জীবনচিত্র এমনই মলিন!

জানা যায়, একদিকে মৎস্য আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে লাগাতার বর্ষাসহ নানা সমস্যা, ঋণের বোঝা, মাছ শিকার করতে না পারায় প্রায় তিন হাজার জেলে পরিবারের জীবিকা হুমকির মুখে। জেলেপল্লীর সকলেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। বেঁচে থাকার তাগিদে বন্যা ঝড় জলোচ্ছ্বাস কিছুই তাদের আটকাতে পারে না। সাগর থেকে ফিরে আসবে কিনা তাও তারা জানে না। প্রতিবছর সাগরে ইলিশ ধরতে গিয়ে জেলেরা প্রাণও হারাচ্ছে।

জেলেদের আহরণ করা মাছ বিদেশে রপ্তানি করে অনেক ব্যবসায়ী কোটিপতি হলেও দারিদ্র্যতার বেড়াজালে ঘেরা জেলে পরিবারগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন নেই। চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা, ইপিজেড, বন্দর, হালিশহর, আনন্দবাজার, পাথরঘাটা, রাণী রাসমনি ঘাট, কাট্টলিসহ সকল জেলে পল্লীগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝড়, তুফান ও বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে সমুদ্রে মৎস্য শিকারের মাধ্যমে তারাই দেশের বিপুল আমিষের চাহিদা যোগান দেন। যার ফলে বাংলাদেশ এখন মাছের উৎপাদনে তৃতীয় স্থান দখল করে এক নজির সৃষ্টি করলেও এসব হতদরিদ্র জেলে পরিবারগুলোর জীবনমানের কোন উন্নয়ন হয়নি।

ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আমিষের অভাব মেটায় যারা 1

পতেঙ্গা জেলেপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা আজালা জলদাস বলেন, বাপ-দাদার পেশাকে অবলম্বন করে বংশ পরম্পরায় বেড়ে ওঠা আমরা জেলে পরিবার সমাজে বঞ্চনা-বৈষম্য, জীবনের নিরাপত্তা, জলদস্যুর হামলা ও উচ্চ সুদের ঋণে আক্রান্ত। আমাদের ভাগ্যে ছিটেফোঁটা সাহায্য সহযোগিতা জুটলেও আমরা বঞ্চিত বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সুযোগ সুবিধা থেকে। ইলিশের মৌসুমে পতেঙ্গা থেকে কাট্টলি পর্যন্ত হাতিয়া, নোয়াখালী, ভোলা থেকে বহিরাগত জেলেদের কারণে প্রকৃত জেলেরা কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছে। মাছ শিকার করতে গিয়ে বহু জেলে প্রাণ হারান। কালাবাশি জলদাশ, পরাণ জলদাশ, বাশি জলদাশ এরকম চিত্র প্রত্যেক জেলেপাড়ায়। এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের খোঁজখবর কেউ রাখে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মহানগরীর দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে মৎস্যজীবীরা। মহাজনদের খুশিমত বেধে দেওয়া দামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে জেলেরা। মহানগরীর শত শত জেলে পরিবার বংশপরম্পরায় নদীতে মাছ শিকার করে নিজেদের জীবন-জীবিকা চালিয়ে আসছে। জেলেরা মৌসুমের শুরুতে নৌকা মেরামত, জাল কেনার জন্য মহাজনদের কাছে আহরিত সকল মাছ বিক্রি করার শর্তে টাকা ধার হিসেবে নেয়। নদীতে যখন মাছের আকাল, মহাজনদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলেই জেলেরা বছরের পর বছর জিম্মি থেকে যান। মাছের দরদাম ঠিক হয় মহাজনের ইচ্ছা অনুযায়ী। মহাজনের দাদনের টাকা ও এনজিওদের চড়া সুদের ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অনেক জেলে।

আনন্দবাজারের স্থায়ী বাসিন্দা রনি জলদাস জানান, ‘আমরা নানান সমস্যায় জর্জরিত। মহাজনের কাছ থেকে আগাম টাকা নেওয়ার কারণে ইলিশের মৌসুমে আমরা ন্যায্যমূল্য পাই না। প্রভাবশালীদের মদদে বহিরাগত জেলেরা জোর করে আমাদের ফাঁড় দখল করে জাল বসানোর চেষ্টা করলে বিভিন্ন সময় এ নিয়ে সংঘর্ষ হয়।

কাট্টলী এলাকার বাসিন্দা বাবুল জলদাস বলেন, ‘পরিবারের ভরণপোষণ জোগাড় করতে সাগরে মাছ ধরতে যাই। সেই মাছ আমরা দাদন নেওয়া আড়তদারের কাছে বিক্রি করি। যা পাই তা দিয়ে সংসার চালাই। আমরা গরিব মানুষ, তাই বাধ্য হয়ে আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নেই। সাগরে মাছ ধরতে একটি ফিশিং বোটে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার চালান লাগে। এত টাকা আমরা পাবো কোথায়? তাছাড়া প্রভাবশালী মহল জোর করে ফাঁড় দখল করে আমাদের ওপর খুব অত্যাচার করে। আমরা প্রায়ই হামলা মামলার শিকার হই। প্রত্যেকটি জেলেপাড়ায় কয়েক হাজার জেলে পরিবার ঋণগ্রস্ত। আমাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম কতটা নিদারুণ, কিভাবে বেঁচে আছি তা যেন দেখার কেউ নেই!

পতেঙ্গা, ইপিজেড, আনন্দবাজার, কাট্টলীসহ চট্টগ্রাম নগরীর জেলেপল্লীতে সরেজমিনে গিয়ে জেলে লিটন জলদাস, সাগর জলদাস, সুজন জলদাস, হরিপদ জলদাস, তপন জলদাসের মতো আরও জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন মহলের তদবিরে ইলিশের মৌসুমে ফাঁড় দখল ও জাল বসানো নিয়ে অধিক মুনাফার লোভে একশ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি রমরমা বাণিজ্য করছেন। এর সঙ্গে আছে কোস্টগার্ডের অভিযান ও হয়রানি। পুলিশের ব্যাপক চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ জেলে ও বোট মালিকরা। এছাড়া টহল পুলিশ এসে প্রতিদিনই জেলেদের কাছ থেকে মাছ নিয়ে যায় – এমন অভিযোগ করেন জেলেরা।

বোট মালিক ও মাছ ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন বলেন, বিনামূল্যে জেলেদের জীবনের নিরাপত্তায় লাইফ বয়া ও জ্যাকেটের ব্যবস্থার পাশাপাশি সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণদান প্রকল্পের ব্যবস্থা করা হলে অনেক জেলে পরিবার স্বাবলম্বী হতো। জেলেরাই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ করছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোমিনুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরে প্রায় তিন হাজার জেলে পরিবারের সরকারিভাবে নিবন্ধিত। এর মধ্যে ৬৭১ জন জেলে ভিজিএফের চাল পেয়ে থাকেন। দুই হাজার ৯০০ জেলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। তবে বর্তমানে এসব পরিবার ভীষণ দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। যদিও বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ নামের একটি প্রকল্প চালু করেছেন। প্রকল্পটিতে দারিদ্র্য নিরসন, বিকল্প সম্পূরক জীবিকা অর্জন, দক্ষতা বৃদ্ধি, পুষ্টি সচেতনতাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। ফলে ফলে মৎস্যজীবীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘ইলিশের মৌসুমে ফাঁড় দখল ও জাল বসানো নিয়ে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। তবে কেউ অভিযোগ করলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ গভীর সমুদ্রে জেলেদের সাথে যোগাযোগেরর জন্য ডিভাইস ব্যবহার করা হবে বলেও তিনি জানান।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!