উপাচার্যের পিএস নিয়ে বিপাকে চবি প্রশাসন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দফতরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম। বিশ্ববিদ্যালয়ে যিনিই উপাচার্য নিযুক্ত হন না কেন, তাকে রাখা হয় উপাচার্যের পিএস হিসেবে। বর্তমান উপাচার্যের বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। যথারীতি পিএসের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কিন্তু সকল উপাচার্যের আস্থাভাজন হওয়ার সুবাদে তিনি হয়ে উঠেছেন এখন এই দফতরের হর্তাকর্তা। তার টেবিলে পড়ে থাকে ফাইলের স্তুপ। উপাচার্যের সামনে এসব ফাইল হাজির করেন তিনি নিজের ইচ্ছায়। দীর্ঘদিন এই চেয়ারে থাকার কারণে এসব স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এসব কারণে পিএস জাহাঙ্গীরকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

অভিযোগ উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন শিক্ষকের ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উপাচার্যের নির্দেশনার বাইরেও কাজ করেন জাহাঙ্গীর আলম। উপাচার্য কোনো কাজের নির্দেশনা দিলেও সেই কাজ ঝুলে থাকে দিনের পর দিন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।

এবার করোনার সময়ে তিনি ঘটালেন আরেক কাণ্ড। অনেকের ধারণা, এর খেসারত দিতে হয়েছে উপাচার্য পরিবারকে। নিজের করোনা আক্রান্ত বোনকে জাহাঙ্গীর দেখতে গিয়েছিলেন। এরপর তিনি নিজেই হলেন করোনা আক্রান্ত। করোনা আক্রান্ত বোনকে দেখতে যাওয়ার তথ্য গোপন করে তিনি উপাচার্য দফতরে নিয়মিত করেছেন অফিস। কিছুদিন পর তার করোনা পজিটিভ আসে। এর পর পর করোনা আক্রান্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার ও তার পরিবারের ৫ সদস্য। করোনায় উপাচার্য ড. শিরীণ হারান তাঁর স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর লতিফুল আলমকে। এ সময় উপাচার্য দফতরের দুই কর্মচারীও করোনা আক্রান্ত হন।

এদিকে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের পদোন্নতির ফাইল আটকে রাখারও অভিযোগ উঠেছে। আবার কোনো কোনো শিক্ষকের পদোন্নতির বোর্ড সভা আহবান করতে উপাচার্য কার্যতালিকার শিডিউল দেখে জাহাঙ্গীর আলমকে সময় নির্ধারণ করতে নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী তারিখ নির্ধারণ করে চিঠিও ইস্যু করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এক শিক্ষকের নির্দেশে উপাচার্যকে না জানিয়েই সে বোর্ড সভা স্থগিত করে দেন জাহাঙ্গীর আলম। ওই শিক্ষকের ইচ্ছা অনুযায়ীই উপাচার্য দফতরের ফাইল প্রক্রিয়া করতেন জাহাঙ্গীর আলম। এমনকি গোপনীয় নানা নথিপত্রও ওই শিক্ষকের কাছে নিয়মিত পৌঁছে যেত জাহাঙ্গীরের হাত হয়ে।

উপাচার্যের পিএস জাহাঙ্গীর আলমের এমন কাণ্ডে বিব্রত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। করোনার প্রাদুর্ভাবের অনেক আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষক পদোন্নতির আবেদন করেন। উপাচার্য দফতরে এক শিক্ষকের অনৈতিক প্রভাবে এসব শিক্ষকের পদোন্নতির বোর্ড সভা আহবান সম্ভব হয়নি। যার নেপথ্যে কাজ করেছেন উপাচার্যের পিএস জাহাঙ্গীর আলম। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দফতরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের কর্মকর্তা হয়ে করোনা আক্রান্ত বোনকে দেখতে যাওয়ার তথ্য গোপন করাকে ‘অপেশাদারি আচরণ’ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়কে করতে হয়েছে লকডাউন। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের চারুকলা ক্যাম্পাস থেকে। এছাড়া জাহাঙ্গীর আলমের ‘অপেশাদার আচরণের’ সবচেয়ে বড় খেসারত বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের পরিবারকে দিতে হয়েছে বলেও মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য দফতরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত ২৯ জুন আমি মুরাদপুর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম। তখন একজন বলল এই দুইটা বুথে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যাম্পল টেস্টিং করে। তখন আমি সেখানে ঢুকলাম। গিয়ে দেখি কোনো লোকজন নাই। এরপর আমি টেস্ট করিয়ে নিই। তখন কিন্তু আমার কোন সিম্পটম (উপসর্গ) নাই। আমি নমুনা দিয়ে চলে আসি। এরপর আমি অফিস করছি। সবাই আমাকে দেখছে। আমার কোন উপসর্গ নাই।’

জাহাঙ্গীর বলেন, ‘পরদিন বিকেলে আমাকে জানানো হল আমার করোনা পজিটিভ। এরপর আমি নিজ থেকে আইসোলেশনে চলে গেছি। এরপর থেকে আমি আর বাসা থেকে বের হইনি। তখনও আমার কোন উপসর্গ নেই। এরপর ডাক্তার বলল আপনি ৫ দিন দেখেন। ৫ দিন পরও যখন কোন উপসর্গ নেই তখন ডাক্তার বলল ১০ দিন অপেক্ষা করেন। এভাবে উপসর্গ ছাড়া ২০ দিন কাটিয়ে ম্যামকে (উপাচার্য) বললাম আমি অফিসে আসবো কিনা? ম্যাম বললেন আরও দুইদিন পর আসেন। দুইদিন পরে অফিসে গিয়ে ম্যাম বা ম্যামের পরিবারের কারো সাথে দেখা হয়নি। অফিস থেকে যাওয়ার পথে আমি আবার টেস্ট করতে নমুনা দিই। পরদিন রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। এরমধ্যে আমি আইসোলেশনে যাওয়ার চারদিন পর উপাচার্য ম্যামসহ ওনার বাংলোর সবার করোনা পরীক্ষা করা হয়। তিন কর্মচারীর করোনা পজিটিভ আসে। কিন্তু ম্যামের পরিবারের কারো পজিটিভ আসেনি। এর এক সপ্তাহ পরে ওনাদের করোনা পজিটিভ আসে।’

বোনকে দেখতে যাওয়ার বিষয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমার বোনকে যে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে আমি সেখানে গিয়েছি। তবে তাকে দেখতে যাইনি। আমি হাসপাতালের নিচে ছিলাম।’

পদোন্নতির বোর্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বোর্ড দেওয়ার বিষয়ে উপাচার্য, রেজিষ্ট্রারসহ সংশ্লিষ্টরা বসে সিদ্ধান্ত নেন। আমি নিজ থেকে কিছু করি না। সবকিছু আদেশক্রমে করে থাকি।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের মন্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলেও সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!