উত্তর যুবলীগের শীর্ষপদ পেতে মরিয়া বর্তমান কমিটির নেতা, নতুন নেতৃত্ব চায় তৃণমূল

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সম্মেলন শেষ হয়েছে প্রায় এক মাস হলো। সম্মেলন জাঁকজমকপূর্ণ হলেও কমিটি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় যুবলীগ। তাই তৃণমূলকর্মীদের চিন্তা এখন উত্তর জেলা যুবলীগের নেতৃত্ব নিয়ে। যোগ্য নেতৃত্ব নাকি অযোগ্যরা হাতিয়ে নেবেন পদ—এই ধরনের প্রশ্নই এখন বেশি শোনা যাচ্ছে। চট্টগ্রামের তিন সাংগঠনিক জেলা উত্তর, দক্ষিণ, মহানগরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তরুণ নেতৃত্ব রয়েছে উত্তর জেলা যুবলীগে। শিক্ষিত ও জনবান্ধব অন্তত ডজনখানেক যুবনেতা রয়েছেন সেখানে। তাই তৃণমূলকর্মীদেরও চাওয়া, যেন তরুণদের হাতেই আসে যুবলীগের নেতৃত্ব।

এর আগে গত ২৯ মে কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি পদে ৭ জন ও সাধারণ সম্পাদক পদে ২২ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়। এদের মধ্যে যেমন রয়েছে ১৯ বছর ধরে চলতে থাকা যুবলীগ কমিটির বর্তমান নেতারা, তেমনি রয়েছে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে ছাত্র রাজনীতি করা বিশ্বস্ত ছাত্রনেতারাও। তবে বর্তমানে যে মানবিক যুবলীগের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে দুঃসময়ে রাজনীতি করা যুবকদের প্রধান্য দেওয়ার দাবি কর্মী-সমর্থকদের।

তরুণ ও দুঃসময়ের ছাত্রনেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে সম্মেলনে জানান কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল।

যারা আছেন আলোচনায়

উত্তর জেলা যুবলীগ নিয়ে কথা উঠলেই সবার আগে যার নাম আসে তিনি হলেন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম রাশেদুল আলম। আলোচিত-সমালোচিত এই নেতা ১৯ বছর ধরে ছিলেন জেলা যুবলীগের দায়িত্বে। কিন্তু এবার তিনি সভাপতির পদ পেতে দৌড় লাগিয়েছেন। তবে উত্তরের যুবলীগের রাজনীতি থেকে সরে গেছেন বর্তমান সভাপতি ও সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আল মামুন।

যুবলীগের সভাপতি পদের জন্য আলোচনায় আছেন ওই কমিটির সহসভাপতি মোস্তফা মানিক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুজিবর রহমান স্বপন।

তরুণদের মধ্যে আছেন উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাজিবুল আহসান সুমন। যদিও তিনি বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে রাজনীতি করছেন। তারপরও আওয়ামী লীগ ছেড়ে তিনি এখন ব্যস্ত আছেন যুবলীগের ‘যুবরাজ’ হতে।

তবে সাধারণ সম্পাদক পদে তরুণদের বেশি আগ্রহ দেখা গেছে। উত্তর জেলা থেকে এই পদে যে ২২ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রায়ই তরুণ। এছাড়া এসব তরুণরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ২০০১-২০০৬ এবং ১/১১ এর মত দুঃসময়ে।

সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী এসএম আল নোমান। তিনি উত্তর জেলা আওয়ামী যুবলীগের বর্তমান সহ-সভাপতি। এছাড়াও ওমরগনি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি পদে থেকে তিনি রাজপথে লড়েছেন বিএনপি—জামায়াত বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে। সীতাকুণ্ড উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি ও ১০ নম্বর ছলিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি ছিলেন এসএম আল নোমান।

উত্তর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী এসএম আল নোমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্যাসিনো-কাণ্ড ও শুদ্ধি অভিযানের পর যে মানবিক যুবলীগ গঠনের জোয়ার উঠেছে সেখানে যদি কোনো অদক্ষ ও অসৎ যুব সংগঠকের হাতে দায়িত্ব যায় তবে তা তৃণমূলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।’

নোমান ছাত্র অবস্থায় নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম ওমরগনি এমইএস কলেজে। যুবলীগ নিয়ে নোমান বলেন, ‘ছাত্র অবস্থায় রাজনীতি করেছি। তারপর যখন যুবলীগের রাজনীতি শুরু করি তখন থেকেই মানবিক কাজগুলোতে সরাসরি যুক্ত ছিলাম। যদি স্বচ্ছ ও মেধাবীরা যুবলীগের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পায় তবে স্বপ্নের মানবিক যুবলীগ পথ দেখাবে যুবকদের।’

সাধারণ সম্পাদক পদের আলোচিত আরেকজন হলেন উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহসম্পাদক সৈয়দ মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু। উত্তরের ছাত্রসমাজকে নেতৃত্ব দেওয়া সেই মঞ্জু এখন হাল ধরতে চান যুবকদের।

কেমন কমিটি আশা করেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মঞ্জু বলেন, ‘যেসব নেতা দল ক্ষমতায় না থাকার পরও আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে গেছে এবং বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় যারা রাজনীতিতে কঠিন সময় পার করেছে তাদের নির্বাচিত করলে কেন্দ্রীয় কমিটির নিকট কৃতজ্ঞ থাকবো।’

উত্তরের সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে চান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. খালেদ। এছাড়াও চবির সাবেক নেতা হিসেবে আছেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন। তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তৎকালীন শিবির অধ্যুষিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বর্তমানে উপজেলা যুবলীগের দায়িত্বে থাকার পরও প্রমোশন নিয়ে জেলা কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাম লেখাতে চাইছেন সন্দ্বীপ উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ও সীতাকুণ্ড উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মো. শাহজাহানও।

তালিকায় আরও আছেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মেনন। সিটি কলেজের এই সাবেক ছাত্রনেতা চান উত্তরের যুবকদের সংগঠিত করে স্বপ্নের মানবিক যুবলীগ উপহার দিতে।

তবে এসএম আল নোমানের কথার মতই নিজেদের ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন উত্তরের তৃণমূলকর্মীরা। কেমন যুবলীগ চান—প্রশ্নটি করা হয় উত্তর জেলার কামরুল ইসলাম নামে এক যুবলীগ কর্মীকে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, একটি তারুণ্যনির্ভর যুবলীগ আসুক উত্তরে। কারণ, যারা বর্তমান জেলা যুবলীগের কমিটিতে শীর্ষ দুই পদে যারা আছেন তারা গত ১৯ বছর ধরে আমাদের কিছুই দিতে পারেননি। তাই তাদের কাছে নতুন করে আর স্বপ্ন বাজি রাখতে চাইছি না। সেজন্য আমরা সর্বস্তরের তৃণমূলকর্মীরা চাই, উত্তরে যে যুবলীগের কমিটি আসছে তাতে যেন পরীক্ষিতদের স্থান দেওয়া হয়।’

কামরুলের মতো ক্ষোভ ঝেড়ে উত্তর যুবলীগের একাধিক কর্মী জানান, বর্তমান জেলা যুবলীগ সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তারা দলের পদ বিক্রি করে হয়েছেন টাকাওয়ালা-চেয়ারম্যান। উত্তরের ৭টি ইউনিটের মধ্যে তারা ১৯ বছরে মাত্র ৩টিতে কমিটি ঘোষণা করতে পেরেছে। হাটহাজারীর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ইউনিটে গত ১২ বছরেও কোনো সম্মেলন করতে পারেনি বর্তমান জেলা যুবলীগ। তাই জেলা কমিটিতে পরিবর্তন আসুক, পুরাতনদের আবারও দায়িত্ব দিয়ে সংগঠনকে যেন আরও পিছিয়ে দেওয়া না হয়।

২০০৩ সালে সৈয়দ মফিজ উদ্দিনকে সভাপতি ও এমএম শফিউল আজমকে সাধারণ সম্পাদক করে উত্তর জেলা যুবলীগের কমিটি ঘোষণা হয়। এরপর ২০১৩ সালে তারা জেলা আওয়ামী লীগে যোগ দিলে তাদের জায়গায় পরবর্তী ১ নম্বর সহ-সভাপতি এসএম আল মামুনকে সভাপতি ও ১ নম্বর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এসএম রাশেদুল আলমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। যদিও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি-সম্পাদককে কখনও ভারমুক্ত করেনি কেন্দ্রীয় যুবলীগ। কিন্তু তারপরও তারা নিজেদের ভারমুক্ত হিসেবে পরিচয় দেন সব জায়গায়। এই দু’নেতা যুবলীগের পদে থেকে সামলাচ্ছেন উপজেলা পরিষদের দায়িত্বও। এসএম আল মামুন সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও রাশেদ হাটহাজারী উপজেলার। তবে মামুন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তিনি উত্তর জেলা যুবলীগের প্রার্থী হননি।

এদিকে ১৯ বছর ধরে যুবলীগের নেতৃত্বে থাকা হাটহাজারী উপজেলা চেয়ারম্যান রাশেদ এবার উত্তরের সভাপতি হতে চান। কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর খুব ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত তিনি। এমনকি ওমর ফারুক চৌধুরীকাণ্ডেও যুবলীগের নেতাকর্মীদের মুখে ‘বিতর্কিত’ হিসেবে শোনা যায় উত্তর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও হাটহাজারী উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম রাশেদের নাম।ক্যাসিনো-কাণ্ড ও শুদ্ধি অভিযানের পর ওমর ফারুক চৌধুরীর নেতৃত্বে থাকা যুবলীগকে ভেঙে নতুন আঙ্গিকে মানবিক যুবলীগের স্বপ্ন নিয়ে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়।

ওয়ান ইলেভেন ও বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন অনেক নেতা গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, এমনকি বিএনপির নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা করে যারা পিঠ বাঁচিয়েছিলেন তারাও পদের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও হাটহাজারীতে হেফাজত ইস্যুতেও অনেক নেতা চুপ ছিলেন। তাই তৃণমূলের চাওয়া নতুন নেতৃত্ব।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!