উচ্ছেদের আগুনেই আবার পুড়ল শুলকবহরের বস্তি?

চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন শুলকবহর ছাত্তার কলোনীর প্রায় মাঝখানে ছোটন দাশের ভাড়া ঘর। ছোটন দাশ পেশায় প্রাইভেট কার চালক। অন্য দিনের মতো শুক্রবারও (৩১ জানুয়ারি) তিনি গাড়ি চালাতে চলে গেছেন। ঘরে ছিল তার দেড় মাস বয়সী যমজ সন্তান আর স্ত্রী। স্ত্রী ঘরে তালা দিয়ে সন্তানদের নিয়ে আত্মীয়ের বাসায় গেছেন। কিন্তু দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। ছোটন দম্পতি হয়তো জানেনই না সকাল বেলায় সাজানো সংসারের বদ্ধ ঘরে লাগা আগুনে এই কলোনীর আরও ১০৩টি ঘর কেবল ছাই আর ছাই! আগুন লাগার পর তারাই আলোচনায়। তাদের তালাবদ্ধ ঘরই প্রথম জ্বলতে দেখেছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। এর আগে গত শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) একই গলির বাবু কলোনিতে পুড়ে ছাই হয়েছিল দেড় শতাধিক ঘর।

কাকতালীয়ভাবে আগুন লাগার ঘরটিও কলোনির প্রায় মাঝখানে। ঘরটি তালা বদ্ধ। বরাবর এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই শুক্রবার আগুনে জ্বলে শেষ হলো রোকেয়া, হানিফদের মতো মমতাজ খাতুন আর জহিরুলের সংসারও। আগুন লাগার স্থান, ধরণ, সময় মিলে যাওয়ায় সবাইকেই ভাবাচ্ছে— এটি কি নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত কোনো নাশকতা?

কুমিল্লার জহিরুল ইসলাম স্ত্রী মমতাজ খাতুন আর সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করছেন এই কলোনিতে। মমতাজ খাতুন মানুষে বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। আজও কাজে গিয়েছিলেন। কাজে থাকতেই আগুন লাগার খবর শুনে এসে দেখে দাউদাউ আগুন গিলে খাচ্ছে তার সাজানো সংসার। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর জ্বলে যাওয়া ছাই থেকে কুড়িয়ে আনা হলো তাদের কুমিল্লার বাড়ি-ঘরের দলিপত্রাদি। জায়গা-জমির দলিলের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘ইনে আগুন লাগাই দিইয়্যে! আঁরারে ইত্তুন সরাই দিত চার (ওরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের এখান থেকে সরিয়ে দিতে চায় ওরা)।’

৮০ বছরের বৃদ্ধা মোস্তফা খাতুন বলেন, আমার বাপ-দাদার বসবাস এই জায়গায় ছিল। আমরা একশ বছরের বেশি সময় এই বিটে বাড়িতে আছি। শুলকবহরের সামসু চেয়ারম্যানের ছেলে শাহনেওয়াজ বাবু আমাদের এখান থেকে উচ্ছেদ করতে চায়। গত শুক্রবার বাবু কলোনিতে আগুন লাগার পর তিনি বলেছিলেন ‘এই কোণায় লাগেনি’। আজ এক সপ্তাহ পর আমাদের কলোনি শেষ হয়ে গেল।’

একই সুরে শাহনেওয়াজ বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেন মোহাম্মদ আজিজও। মো. আজিজ জানান, ‘এখান থেকে আমাদের উচ্ছেদ করতে ওয়াসা, গ্যাস, বিদ্যুৎ সবাইকে টাকা পয়সা দিয়ে আমাদের লাইনগুলো কয়েকবার বন্ধ করা হয়েছে। আমার নানার সম্পত্তিতে আমরা বসবাস করি। আদালতে মামলাও চলছে।’

শাহনেওয়াজ বাবুর চাচাতো ভাই মামুনুল ইসলাম হুমায়ুন জানান, পুরো সম্পত্তিটা আমার দাদা আব্দুল হামিদ সওদাগরের ওয়াকফ করা। এখন কেউ কেউ ব্যক্তিমালিনার সম্পত্তি দাবি করে মামলা করেছে। ওয়াক্ফ বনাম কিছু ব্যক্তির মামলা চলছে। সম্পত্তি যেহেতু ওয়াকফ করা আমরা সেখানে হাইরাইজ বিল্ডিং করার কোন সুযোগ নেই। আজকের আগুনটা আমাদেরও সন্দেহ হচ্ছে। আগুন লেগেছে নাকি লাগানো হয়েছে। সরকারের একাধিক সংস্থা আছে। তারা দায়িত্ব নিয়ে সেটা বের করার অনুরোধ আমােদের থাকবে।

বিগত ৫ বছর বিধবা তঞ্জুমা বেগম এই কলোনীতে থাকতেন চার ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে। চার ছেলে ও বড় মেয়ের আলাদা ঘর। সবার সংসারে বাচ্চা আচ্ছে। তিনি ছোট মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। মেয়েটিও ডিগ্রি পাস করলেন। বিয়ের ঘর আসছে বিভিন্ন দিক থেকে। ছোট বোনকে ভালো জায়গা বিয়ে দেওয়া, সাথে শেষ বিয়ে হিসেবে বড় আয়োজনের খরচও তারা জমিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখায় সব উবে গেলো। তঞ্জুমা বেগম বললেন, সব শেষ, কোথায় যাবো এখন?

ডিশলাইনের মিস্ত্রি সালামত আলীরা ৪ ভাই। তিন ভাই কাজ করেন, এক ভাই মাদ্রাসায় পড়েন। তাদের সবার বড় মোহাম্মদ আলী। মোহাম্মদ আলী জানান, ঘর থেকে বের হয়ে মুখ ধোয়ার জন্য গেলাম। ওখানে থাকতেই আগুন আগুন চিৎকার শুনে গলিতে আসি। দেখি ছোটন ড্রাইভারের ঘর জ্বলছে। আমরা পানি মেরে নেভানোর চেষ্টা করেছি। মুহূর্তেই আগুন সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

স্থানীয়রা জানান, গত শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) বাবু কলোনীতে দেড়শতাধিক ঘর জ্বলে যারা খোলা আকাশের নিচে তাদের জন্য আজ দুপুরে খাওয়ার আয়োজন হয়েছিল। অন্য দিন কেউ না কেউ, কিছু না কিছু সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে যান। আজকের আগুনে ঘরহারা মানুষের কাতারে যোগ হলো আরো শতাধিক পরিবার।

এফএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!