ইলিয়াস কোবরা রহস্য, কতোটুকু ঘনিষ্ঠ ছিলেন প্রদীপ-লিয়াকতের?

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ হত্যামামলায় হঠাৎ করেই আলোচনায় চলে এসেছে রূপালি পর্দার একসময়কার খ্যাতিমান খলনায়ক ইলিয়াস কোবরার নাম। বলা হচ্ছে সিনহা রাশেদকে যেদিন (৩১ জুলাই) গুলি করে হত্যা করা হয়, সেদিন চলচ্চিত্রে খলচরিত্রের অভিনেতা ইলিয়াস কোবরার মাধ্যমে ফাঁদ পেতে সময়ক্ষেপণের কৌশল করেছিলেন টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। যদিও ইলিয়াস কোবরা এই আলোচনা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন সিনহা নামে কাউকে তিনি চিনতেনই না। তবু এই স্থানীয় পর্যায়ে এই বিষয়ে চলছে নানা কানাঘুষা।

জানা গেছে, ইলিয়াস কোবরার বাড়ি মেরিন ড্রাইভের পাশে বাহারছড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নোয়াখালীপাড়ায়। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি সংবাদের সূত্রে জানা গেছে, ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতের ঘনিষ্ঠ ইলিয়াস কোবরা নিহত সিনহা রাশেদকে আমন্ত্রণ করে তার বাড়িতে নিয়ে কালক্ষেপণ করান। সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর তার দেওয়া তথ্যেই অনুসরণ করে সিনহাকে হত্যা করা হয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নিজ ওয়ার্ডের মাদক প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ইলিয়াস কোবরা ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতের সঙ্গে আঁতাত করে মানুষকে হয়রানি করেন। এমনকি ওসি প্রদীপের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে ক্রসফায়ারের তালিকাভুক্তদের মোটা অংক লেনদেনের মাধ্যমে ক্রসফায়ার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার কাজ করার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

টেকনাফ বাহারছড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মাদক নির্মূল কমিটির সভাপতি ইলিয়াস কোবরা
টেকনাফ বাহারছড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মাদক নির্মূল কমিটির সভাপতি ইলিয়াস কোবরা

তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ইলিয়াস কোবরা বলছেন, তাকে স্পর্শকাতর এই মামলায় ফাঁসানোর অপচেষ্টা চলছে। সোমবার (১০ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইলিয়াস কোবরা বলেন, ‘আমি জানতামই না যে মেজর সিনহা নামে কেউ আছে। আমি জীবনে-স্বপ্নেও তাকে দেখিনি। কেন জানি না এক সাংবাদিক এমন বড় একটি ঘটনার সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে কাল্পনিক কথা লিখছে। আমি নিজেই মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করি। মসজিদ কমিটিতেও আছি। এসব কারণে এলাকার কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে আছে।’ এমনকি ওসি প্রদীপের সাথেও কোনো যোগাযোগ ছিল না বলেও দাবি করেছেন তিনি।

তবে আলোচিত এই মামলায় হঠাৎ ইলিয়াস কোবরার দৃশ্যপটে হাজির হওয়া একটুও অবাক করছে না স্থানীয়দের। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় চলচ্চিত্রের এক সময়ের এই প্রভাবশালী খলনায়কের সাথে ওসি প্রদীপের সম্পর্কের কথা সকলেই জানতো এলাকায়। প্রদীপ ওসি হয়ে আসার পর থেকেই এলাকায় অবস্থান নেন তিনি। এই সময়ে নির্দিষ্ট কোনো ব্যবসা বা পেশাও ছিল না তার। তবে ওই এলাকায় প্রকৃত অর্থে ইলিয়াস কোবরার কোনো বাগানবাড়ি আছে কিনা কিংবা সেই বাড়িতে ঘটনার দিন মেজর সিনহা গিয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কেউ কিছু জানাতে পারেননি।

তবে এই ঘটনায় এর মধ্যেই কয়েক দফায় ইলিয়াস কোবরাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে জানিয়ে স্থানীয় একটি সূত্র চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত দুই দিন ধরে ইলিয়াস কোবরাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এটা তো সবাই বলাবলি করছে যে এই ঘটনায় উনাকে গোয়েন্দারা নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন।’

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইলিয়াস কোবরার এখানে কোনো ভূমিকা আছে কি নেই তা বলতে পারবো না। তবে ওসি প্রদীপের সাথে উনার কোন পরিচয় বা সম্পর্ক ছিল না বলে যে দাবি তিনি করেছেন সেটিও সত্য নয়। যেদিন ঘটনা ঘটেছে সেদিনও তো সারাদিন ওসি প্রদীপ আর এসআই লিয়াকতসহ পুলিশ ফোর্স নিয়ে নোয়াখালীপাড়ায় ছিলেন তিনি।’

এই বিষয়ে ইলিয়াস কোবরা বলেন, ‘লিয়াকতের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। তার বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রটির মধ্যেই আমাদের এলাকা। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়। সাবেক মেজরের মৃত্যুর দিনও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার নামেই এখানে একটা বাজার আছে। সেখানে কমিটির অফিসে বসে ছিলাম। মোহাম্মদ নামে একজন সদস্য বলেন, একটি বস্তা পাওয়া গেছে। তখন লিয়াকত সাহেবকে ফোন করলে এসে নিয়ে যান। টেকনাফ থানার এসআই হাসান আমাদের সেই সদস্যকে নিয়ে গেছেন। তখন আমি তাকে বললাম, যিনি দেখে জানিয়েছে, তাকেই যদি নিয়ে যান তাহলে খবর দেবে কে? পরে দুবার ফোন দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করি। তারা ছেলেটিকে ৫৪ ধারায় চালান দেয়। সে শনিবার (৮ আগস্ট) জামিনে ছাড়া পেয়েছে।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলেও টেকনাফ এলাকায় রাজনীতিসহ নানা কাজে দাপুটে ভূমিকা ছিল ইলিয়াস কোবরার। মাঝে কিছু সময় এলাকায় দেখা না গেলেও প্রদীপ কুমার টেকনাফ থানার ওসি হিসেবে যোগ দেওয়ার পর এলাকায় সক্রিয় হন তিনি। প্রদীপের হাত ধরেই ইলিয়াস কোবরা বাহারছড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মাদক নির্মূল কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। মেরিন ড্রাইভের পাশে নোয়াখালীপাড়ার পৈতৃক বসতিতে ‘ইলিয়াস কোবরা বাজার’ নামে একটি বাজারও চালু করেন। উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া নিজের নামে এরকম বাজার বসানোর কারণে আদালতে মামলাও চলছে।

অভিযোগ রয়েছে, ইলিয়াস কোবরা মাদক নির্মূল কমিটির সভাপতি হলেও তার পরিবারের অনেক স্বজন ইয়াবা কারবারে জড়িত। এমনকি নিজের ভাই রফিক কোবরা রাজধানী ঢাকা ও টেকনাফ থানার ইয়াবা মামলার আসামি। আরেক ভাই শামশু কোবরার দুই ছেলেও ঢাকা এবং চট্টগ্রামের ইয়াবা মামলার আসামি। তারা সবাই ইয়াবা মামলায় জেলেও আটক ছিলেন।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!