ইপিজেডে ‘পুলিশের লোক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজি করে চারজন

জাহাঙ্গীর, রাজু ও রফিকুল আর ক্যাশিয়ার সুলতান। চট্টগ্রামের ইপিজেড থানা এলাকার বাসিন্দা তারা। বন্দরটিলা, হাসপাতাল গেইট থেকে আকমল আলী রোড, এস আলম-বি আলম গলিজুড়ে তাদের অবাধ বিচরণ। নিজেদের তারা দাবি করেন ‘পুলিশের লোক’। সড়কগুলোতে যত স্থায়ী, অস্থায়ী দোকান ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে সবগুলোকেই ‘রাতের বাণিজ্যে’র ভাগ দিতে হয় এই চারজনকে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে রাত ৮টার পর দোকান বন্ধ রাখার আদেশ থাকলেও ইপিজেড থানার ওই এলাকাগুলোতে সেই আদেশ কার্যকর হয়নি কখনোই। এর নেপথ্যেও এই চারজন। তাদের হাতে গুঁজে দিলেই সরকারি আদেশেরও আর ধার ধারতে হয় না। সেক্ষেত্রেও আছে নিয়ম। দুই ঘণ্টা বাড়তি দোকান খোলা রাখতে হলে তাদের দিতে হয় ৩০ টাকা মাশুল। বেশি সময়ের জন্য বেশি মাশুর। প্রায় দুই শতাধিক দোকান থেকে দৈনিক ছয় হাজার টাকা মাসোহারা পান এই চার ‘পুলিশের লোক’। কেউ এই মাসোহারা দিতে অস্বীকার করলে তাদের হতে হয় নাজেহাল, নয়তো বরাদ্দ থাকে পুলিশি হয়রানি।

জানা গেছে, ইপিজেড এলাকায় দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানভেদে দিনে ২০ থেকে ৩০ টাকা করে ঘুষ দিতে হয় পুলিশের সোর্সদের। এ টাকা সোর্সদের দিলে সরকারের আদেশ অম্যান্য করে রাত ১০টা কিংবা ১১টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখা যায়। প্রতিদিন এলাকাভিত্তিক থানার সোর্সরাই এই চাঁদার টাকা নেয়।

এলাকাবাসী জানায়, ইপিজেড থানা এলাকার বন্দরটিলা, হাসপাতাল গেইট, আকমল আলী রোড, এস আলম-বি আলম গলিসহ বেশ কয়েকটি স্থান থেকে কথিত সোর্স জাহাঙ্গীর, রাজু ও রফিকুল ইসলাম প্রতিদিন এসব চাঁদার টাকা তোলেন। তবে এইসব কথিত সোর্সের গডফাদার সুলতান প্রকাশ ক্যাশিয়ার সুলতান।

আকমল আলী রোড এলাকার এক মুদি দোকানদার নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘করোনার শুরুর দিকে থানার সোর্স সুলতান এসে সরাসরি টাকা নিয়ে যেতো। তখন আমরা দোকানপ্রতি ৫০ টাকা করে দিতাম। এখন সোর্স জাহাঙ্গীর এসে ৩০ টাকা টাকা করে নিয়ে যায়। যার ফলে আমরা ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় বেশি দোকান খোলা রাখতে পারি।’

সরকারি নির্দেশনা না মেনে দোকান খোলা রেখে চাঁদা কেন দেন— এমন প্রশ্নের জবাবে এক দোকানদার বলেন, ‘দিনের বেলায় তেমন বেচাকেনা হয় না। ইপিজেড এলাকায় গার্মেন্টসের ছুটি হয় বিকেলে। তাই সন্ধ্যার পর কাস্টমার বেশি থাকে। তখন বেচাকেনাও ভাল হয়। কিন্তু আমরা চাই সরকারি নির্দেশনা মেনে সব দোকান ৮টার পর বন্ধ থাক। কেউ চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করবে আর কেউ করবে না— এমন কেন হবে?’

এদিকে দোকানদার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই শুধু নয়, থানার কথিত এসব সোর্সের অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না ভ্যানগাড়িতে করে ফুটপাতের কাঁচামাল বিক্রেতারাও। তাদের কাছ থেকেও নেওয়া হয় দৈনিক ২০ টাকা করে। এই চাঁদার টাকা না দিলে সোর্স এসে ছিনিয়ে নেয় ওজন মাপার যন্ত্র।

জাহেদুল নামে একজন কাঁচামাল বিক্রেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সোর্স জাহাঙ্গীর প্রতিদিন বিকেলে আসে। রাস্তায় যতগুলো ভ্যানগাড়ি আছে সবার কাছ থেকে ২০ টাকা করে তোলেন। আর টাকা না দিলে তারা ব্যবসা করতে দেয় না। একদিন চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় আমার মিটার স্কেল ছিনিয়ে নেয় সোর্স জাহাঙ্গীর।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন তাই বাধ্য হয়ে চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। তা না হলে বিভিন্ন হয়রানি করে ওরা। ব্যবসা না করলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে চাঁদা দিই।’

তবে শুধু করোনা বা লকডাউনের সময়েই নয়, সবসময় এই চাঁদা দিতে হয় সোর্সদের। করোনাভাইরাসের প্রকোপের আগেও চাঁদা দিতে হয়েছে এসব দোকানি ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের।

এ বিষয়ে ইপিজেড থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া বলেন, ‘আমি সবেমাত্র করোনা পজিটিভ থেকে সুস্থ হয়েছি। কয়েকদিন পর রেগুলার অফিস করবো। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে দোকান খোলার বা দোকান খোলাকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির কোনো সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই সরেজমিনে গিয়ে ব্যবস্থা নেবো। যেন সকল দোকানপাট সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী রাত ৮টার পর বন্ধ থাকে।’

তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ কমিশনার (বন্দর জোন) কামরুল ইসলাম কোনো মন্তব্য না করে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!