ইউপির ভোটে নৌকা হটিয়েছে নৌকার লোকই, বড় নেতারা এঁকেছেন নীলনকশা

উঠেছে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ নালিশও

তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অবাধ ভোটগ্রহণের বিষয়ে প্রায় সব মহল ‘একমত’ দেখা গেলেও অবাধ ভোটের সেই নির্বাচনে পুরনো ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ অভিযোগ উঠছে শাসক দল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের তরফ থেকে। আর এসব ‘ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ জন্য ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের দিকেই অভিযোগের আঙ্গুল তুলছেন তারা। দলীয় গ্রুপিংয়ের কারণে প্রভাবশালী নেতারা বিভিন্ন এলাকায় ‘অপছন্দের’ দলীয় প্রার্থীদের পরাজিত করতে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন— এমন অভিযোগই করছেন দলের নেতাকর্মীরা।

দেখা গেছে, চট্টগ্রামে রোববার (২৮ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত রাঙ্গুনিয়া ও হাটহাজারী উপজেলার ২৬টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ১৯টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এবং ৭টি ইউনিয়ন পরিষদে বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। একইদিন কক্সবাজারের ১৬ ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছয় ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী, তিনটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং ছয়টিতে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী জয় পেয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের আস্থা পেলেও পরাজিত হওয়া নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা দলের প্রভাবশালী নেতাদের প্রকাশ্য ও গোপন বিরোধিতার শিকার হয়েছেন।

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ধলই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েও নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শাহনেওয়াজ চৌধুরী। পরাজয়ের জন্য সরাসরি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ সালাম এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও হাটহাজারী উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম রাশেদুল আলমকে দায় দিচ্ছেন তিনি। শুধু নির্বাচনে পরাজিত হওয়াই নয়, নির্বাচনে তার পক্ষ নেওয়া কর্মীদের টানা হামলার শিকার হতে হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে তিনি বলছেন, এসব হামলার ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না তিনি।

তবে শাহনেওয়াজ চৌধুরীর এমন অভিযোগ শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম বলছেন, শুধু হাটহাজারী নয় বরং বাইরের বিভিন্ন এলাকার নেতাকর্মীরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে শাহনেওয়াজ চৌধুরীর নির্বাচন করেছেন। তবু এমন অভিযোগ কেন আসছে সেটি বুঝতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

অন্যদিকে কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নে পরাজিত হওয়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী শহীদুল ইসলাম চৌধুরী নকল সিল ও নকল ব্যালট পেপারের মাধ্যমে প্রতিটি কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি করে তাকে পরাজিত করার অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যে একটি কেন্দ্র থেকে নকল সিল আর নকল ব্যালট পেপারও জব্দ করেছেন তিনি। পাশাপাশি প্রবাসে থাকা ভোটারের ভোট ‘কাস্ট’ দেখানো হয়েছে বলেও অভিযোগ তার। এসব অভিযোগে এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। আর এসব কিছুর পেছনে স্থানীয় সাংসদ জাফর আলমের সরাসরি হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে অভিযোগ তার।

তৃতীয় দফা নির্বাচনে হাটহাজারীর ধলই থেকে মনোনয়ন পাওয়া শাহনেওয়াজ চৌধুরীকে ঘিরে আলোচনা ছিল শুরু থেকেই। প্রথমে মনোনয়ন পাননি তিনি। কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের অনুমোদিত তালিকায় তার নামের ওপর দেওয়া ‘টিক মার্কে’ ছিল রহস্যজনক কাটাছেঁড়া। এ সূত্রে টাকার বিনিময়ে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের অনুমোদন বদলে দেওয়ার অভিযোগও তুলেছিলেন শাহনেওয়াজের সমর্থকরা। কেন্দ্রীয় কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে মনোনয়ন বেচাকেনার নালিশও তোলা হয় তখন। তবে নাটকীয়ভাবে খোদ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান শাহনেওয়াজ চৌধুরী। সেই শাহনেওয়াজ চৌধুরীর পরাজয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের স্বাভাবিকভাবেই হতাশ করেছে। নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে শাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনের মাঠে ছাত্রলীগ ছাড়া কেউই ছিল না। আওয়ামী লীগের যেসব নেতারা এমএ সালাম ভাই আর উপজেলা চেয়ারম্যান রাশেদুল আলমের ঘনিষ্ঠ তাদের কেউই মাঠে ছিল না। তার ওপর প্রশাসন ছিল অনেক বেশি বৈরী। নৌকার কর্মীদের কেন্দ্রে দাঁড়াতেই দিচ্ছিল না। কেন্দ্রে কেন্দ্রে র‍্যাব-ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকাও ছিল আক্রমণাত্মক। এসব কিছু ভোটের মাঠের পরিস্থিতি বদলে দিয়েছিল।’

প্রার্থী হিসেবে এসব বিষয়ে তার পরিকল্পনা ছিল না কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে শাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, ‘আমি তো সংগঠনের প্রার্থী। সংগঠন যেভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে বলেছে, সেভাবেই করেছি। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একটা কমিটি করে দিছে, কিন্তু তারা ভোটের মাঠেই ছিল না। যেহেতু নেত্রীর হস্তক্ষেপে মনোনয়ন পেয়েছি, এর পরে সংগঠনের ভেতর থেকে ষড়যন্ত্র হবে এমন তো ভাবতেই পারিনি আমি। এর মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এখন নৌকার কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা করা হচ্ছে। কয়েকজনকে ভরা বাজারে ধরে মারধর করেছে। আমি প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নাই।’

এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ সালামের কাছে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘শাহনেওয়াজ চৌধুরীর নির্বাচনে আমি দেখেছি সবাই খুব আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছে। শুধু ধলই না, পুরো হাটহাজারী থেকে এমনকি ফটিকছড়িসহ আশপাশের এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার জন্য কাজ করেছে। এখন কারা নির্বাচন করেনি এটা দুয়েকজনের নামও বলা গেলে বিষয়টি আমি দেখতাম।’

স্থানীয় একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ যে শাহনেওয়াজ চৌধুরীকে একলা মাঠে ছেড়ে দিছে—এটা তো সবাই জানে। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক একদিনের জন্য নৌকার নির্বাচন করে নাই। কমিটির ৪ যুগ্ম আহ্বায়কের মধ্যে একজন আলী আবরাহা দুলাল অসুস্থতার কথা বলে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। নির্বাচনের পর দিন তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় আসেন। আরেকজন হাসান শহীদ মিলন নির্বাচনের মধ্যে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে গেছেন, আসছেন নির্বাচনের আগের দিন। আরেকজন মো. আলমগীর— উনি মাঠে কোনো কাজ তো করেনইনি, উল্টো সবখানে বলে বেড়াইছেন এখানে সুষ্ঠু ভোট হবে। কেউ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। অথচ তার কেন্দ্রে নৌকা পাইছে ৮৫৩ ভোট, আনারস পাইছে ১৫০৮ ভোট। এসব কিছু দেখলে তো স্পষ্ট বোঝা যায় কার কী ভূমিকা।’

অন্যদিকে কক্সবাজারের পেকুয়ায় এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে স্মরণাতীতকালের সবচেয়ে অবাধ নির্বাচন বলছেন ভোটাররা। তবে সেই নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণায় ‘ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ অভিযোগ তুলছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত একজন প্রার্থী।

রোববার (২৮ নভেম্বর) পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করতে নকল সিল ও ব্যালট পেপার ব্যবহার করে মেকানিজম করে ভোটের ফল বদলে দেওয়া হয়েছে— এমনই অভিযোগ নৌকা নিয়ে হেরে যাওয়া শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে ভোট প্রয়োগের নকল সিল ও নকল ব্যালট পেপারের সাহায্যে প্রতিটি কেন্দ্রে ভোট কারচুপি করে আমাকে হারিয়ে দেওয়া হয়।’

নিজের দাবির সপক্ষে প্রমাণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৩০ নভেম্বর তারিখে ৪ নম্বর ওয়ার্ড ভেলুয়ার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে নকল ব্যালট পেপার এবং নকল সিল উদ্ধার করেছি আমরা।’

সেসব নকল ব্যালটে কেন্দ্রে না আসা ভোটারদের ভোট কাস্ট করে সেগুলো ব্যবহার করে নির্বাচনী ফলাফল বদলে দেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘প্রবাসী ব্যক্তিকে উপস্থিত দেখিয়ে জালভোট সংগ্রহ করা হয়েছে। এমন দুজন ভোটারের তথ্য আমার কাছে আছে— যাদের একজনের ভোটারের ক্রমিক নম্বর ৫৭, ভোটার নম্বর ২২০৬১৭৩২০৬৫৪। ভোটার ক্রমিক নম্বর ১০২ ও ভোটার নম্বর ২২০৬১৬৩২২৬২। এরকম আরও অন্যান্য কেন্দ্রে মৃত ব্যক্তি ও বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের জাল ভোট প্রদান করা হয়। নির্বাচনে ভোট গণনার সময়ও ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নেওয়া হয়।’

কিন্তু এসব কিভাবে সম্ভব— এমন প্রশ্নের জবাবে সরাসরি কক্সবাজার-১ (চকরিয়া ও পেকুয়া) আসনের সাংসদকে অভিযুক্ত করে এম শহীদুল ইসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্থানীয় সাংসদ জাফর আলম আমার বিরুদ্ধে ছিলেন। উনার হস্তক্ষেপেই এসব হয়েছে। তিনি দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রেও আমার বিরোধিতা করেছেন। সেখানে সফল না হয়ে তিনি নির্বাচনে আমাকে পরাজিত করেছেন। আমি ২৯ নভেম্বর তারিখ সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার বরাবর পুনরায় ভোট গণনার জন্য আবেদন করেছি। হাতে আসা প্রমাণও দিয়েছি। আশা করি এসব অভিযোগ তদন্ত করে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেবে।’

তবে শহীদুল ইসলামের এসব অভিযোগের ব্যাপারে চেষ্টা করেও সাংসদ জাফর আলমের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!